১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী) সময়কাল: ১০.০৪.১৯৭১ হতে ১০.০১.১৯৭২ ইং
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সময়কাল: ১০.০১.১৯৭২ হতে ১২.০১.১৯৭২ ইং
৩. বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ১২.০১.১৯৭২ হতে ২৪.১২.১৯৭৩ ইং
৪. মোহম্মদ উল্লাহ ২৭.০১.১৯৭৪ হতে ২৫.০১.১৯৭৫ ইং
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সময়কাল: ২৫.০১.১৯৭৫ হতে ১৫.০৮.১৯৭৫ ইং
৬. খন্দকার মোশতাক আহাম্মেদ ১৫.০৮.১৯৭৫ হতে ০৬.১১.১৯৭৫ ইং
৭. বিচারপতি আবু সাদাত মোহম্মদ সায়েম ০৬.১১.১৯৭৫ হতে ২১.০৪ ১৯৭৭ ইং
৮. লেফটেনেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান (পি.এস.সি) ২১.০৪.১৯৭৭ হতে ৩০.০৫.১৯৮১ ইং
৯. বিচারপতি আব্দুস সাত্তার (অস্থায়ী) ৩০.০৫ ১৯৮১ হতে ২০.১১.১৯৮১ ইং
১০. বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ২০.১১.১৯৮১ হতে ২৪.০৩.১৯৮২ ইং
১১. বিচারপতি এ,এফ.এম আহসান উদ্দিন চৌধুরী ২৭.০৩.১৯৮২ হতে ১১.১২.১৯৮৩ ইং
১২. হুশেইন মোহাম্মদ এরশাদ ১১.১২.১৯৮৩ হতে ০৬.১২.১৯৯০ ইং
১৩. বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মদ (অন্থায়ী) ০৬.১২.১৯৯০ হতে ০৯.১০.১৯৯১ ইং
১৪. আবদুর রহমান বিশ্বাস ০৯.১০.১৯৯১ হতে ০৮.১০.১৯৯৬ ইং
১৫. বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মদ ০৯.১০.১৯৯৬ হতে ১৪.১১.২০০১ ইং
১৬. অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৪.১১.২০০১ হতে ২১.০৬.২০০২ ইং
১৭. ব্যারিষ্টার জমির উদ্দিন সরকার ২১.০৬.২০০২ হতে ০৬.০৯.২০০২ ইং
১৮. অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ ০৬.০৯.২০০২ হতে ১২.০২.২০০৯ ইং
১৯. অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান ১৩.০২. ২০০৯ ....................
DECLARATION
প্রকাশিত লেখা বা মন্তব্য সম্পূর্ণভাবেই লেখক/মন্তব্যকারীর নিজস্ব অভিমত। এর জন্য ashiqurrahman.blogspot.com ব্লগ কর্তৃপক্ষকে কোনভাবেই দায়ী করা চলবেনা।
মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১১
বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১১
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে কিছু কথা
WRITTEN BY PIAL
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানিকে নিয়ে সম্প্রতি কিছু লেখা চোখে এসেছে। যে যার অবস্থান থেকে লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি এবং অনাকাঙ্খিত বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলে ইচ্ছা না থাকলেও নাক গলাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ওসমানী :
১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেছিলেন ওসমানি। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ‘আর্মি সার্ভিস কোর’ বিভাগে কমিশন লাভ করেন। দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যাপ্টেন এবং পরের বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান আসেন, ঐদিনই তাকে লে. কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৫১ থেকে ৫৫ পর্যন্ত খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের তখনকার ইপিআর-এর অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট (বর্তমানে ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাকে কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কর্ণেল ওসমানী ডেপুটি ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস সহ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কর্ণেল পদমর্যাদায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি আওয়ামী লিগে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন। সে বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লিগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের ৪টি থানা (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথ) সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ওসমানী:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী একটি কমান্ডো বাহিনী বনানীতে ওসমানীর বাড়িতে হামলা চালায়। কিন্তু ওসমানী সৌভাগ্যক্রমে পালাতে পারেন। এরপর ছদ্মবেশে দীর্ঘপথ অতিক্রম কুমিল্লার সালদা নদীর অববাহিকায় পৌছে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালী যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী এক্টিভ লিস্টে আহূত হন। ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। এতে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষনা করা হয়। এবং বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষনায় ওসমানীকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে ১২ এপ্রিল থেকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর গঠন করা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তার পেশাগত ক্রমিক নম্বর ৮২১। একই বৈঠকে কর্ণেল আব্দুর রব সেনা প্রধান এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ওসমানীর এ.ডি.সি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় লেফটেনেন্ট শেখ কামালকে (শেখ মুজিবের বড় ছেলে, পেশাভিত্তিক ক্রমিক নং-৮৬৫)। ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন অফিসার ক্যাডেট (৯৯৪) দেওয়ান গাউস আলী। ২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ওসমানী ছিলেন তার অধীনস্থ। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত এই কমান্ড কার্যকর ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অরোরার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। প্রাসঙ্গিক তথ্য ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে এসে ঘাটি গাড়া মিত্রবাহিনীর জেনারেল মানেক শ’র কাছে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী এক টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করতে স্বীকৃতি জানান। মানেক শ আত্মসমর্পনের সময় নির্ধারণ করে দেন।
মুক্তিযুদ্ধে পর ওসমানী :
স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতির প্রতি চরম ত্যাগ ও মহান সেবার স্বীকৃতি হিসেবে ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন যা কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীন নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন ওসমানী। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আগের দায়িত্বসহ ডাক, তার, টেলিফোন ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় (বাকশাল) রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালু হলে এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আওয়ামী লিগ ও সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করেন। ২৯ আগস্ট ১৯৭৫ সালে দেশে সামরিক শাসন চলাকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন এবং ৩ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হেরে যান। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত ওসমানী লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র : মুজিব নগর সরকারের দলিল পত্র, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান/ এএসএম সামছুল আরেফীন, মুক্তিযুদ্ধ কোষ/মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, জন্মযুদ্ধ
লেখকের কথা : তথ্যপ্রমাণেই বোঝা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জায়গায় প্রধান সেনাপতি ওসমানীর আসার প্রশ্নই ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের পর ওসমানী অবমূল্যায়িত হয়েছেন এটাও সত্যি নয়। সামহোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্লগাররা ওসমানী নিয়ে লেখেননি কথাটিও মিথ্যা। ওসমানীর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে সামহোয়ারে পোস্ট দিয়েছি আমিসহ অনেকেই। বাবার পাণ্ডুলিপি যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ ধারাবাহিকে একটি অধ্যায় ছিল ওসমানীকে নিয়ে। কেনো ওসমানীকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। মার্কিন অধিদপ্তরের প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা যায় যে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে যে দাবিগুলো তুলেছিল তাতে ১ নম্বরে ছিল শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি। ৩ নম্বরে বলা হয়েছে পাকিস্তানে অবস্থানরত সব বাঙালী সৈনিকের দেশে ফিরে আসার সুযোগ এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা। আগেই বলা হয়েছে যৌথ কমান্ডের নেতৃত্ব ছিলো অরোরার হাতে। বাংলাদেশের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপসেনাধ্যক্ষ একে খন্দকার। এখন কেন ছিলেন না ওসমানী- এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি থাকতে না পারার জন্য কখনও মন খারাপ করে কোনো বিবৃতি দেননি, লেখেনওনি কোথাও যা দলিলাকারে পাওয়া যাবে। একমাত্র উপায় ওসমানীর বিদেহী আত্মার সঙ্গে প্ল্যানচেটে যোগাযোগ স্থাপন। তাতেও ইতিহাসের কোনো হরফ বদলাবে না বলেই আমার ধারণা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানিকে নিয়ে সম্প্রতি কিছু লেখা চোখে এসেছে। যে যার অবস্থান থেকে লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি এবং অনাকাঙ্খিত বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলে ইচ্ছা না থাকলেও নাক গলাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ওসমানী :
১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেছিলেন ওসমানি। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ‘আর্মি সার্ভিস কোর’ বিভাগে কমিশন লাভ করেন। দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যাপ্টেন এবং পরের বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান আসেন, ঐদিনই তাকে লে. কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৫১ থেকে ৫৫ পর্যন্ত খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের তখনকার ইপিআর-এর অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট (বর্তমানে ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাকে কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কর্ণেল ওসমানী ডেপুটি ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস সহ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কর্ণেল পদমর্যাদায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি আওয়ামী লিগে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন। সে বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লিগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের ৪টি থানা (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথ) সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ওসমানী:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী একটি কমান্ডো বাহিনী বনানীতে ওসমানীর বাড়িতে হামলা চালায়। কিন্তু ওসমানী সৌভাগ্যক্রমে পালাতে পারেন। এরপর ছদ্মবেশে দীর্ঘপথ অতিক্রম কুমিল্লার সালদা নদীর অববাহিকায় পৌছে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালী যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী এক্টিভ লিস্টে আহূত হন। ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। এতে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষনা করা হয়। এবং বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষনায় ওসমানীকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে ১২ এপ্রিল থেকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর গঠন করা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তার পেশাগত ক্রমিক নম্বর ৮২১। একই বৈঠকে কর্ণেল আব্দুর রব সেনা প্রধান এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ওসমানীর এ.ডি.সি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় লেফটেনেন্ট শেখ কামালকে (শেখ মুজিবের বড় ছেলে, পেশাভিত্তিক ক্রমিক নং-৮৬৫)। ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন অফিসার ক্যাডেট (৯৯৪) দেওয়ান গাউস আলী। ২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ওসমানী ছিলেন তার অধীনস্থ। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত এই কমান্ড কার্যকর ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অরোরার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। প্রাসঙ্গিক তথ্য ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে এসে ঘাটি গাড়া মিত্রবাহিনীর জেনারেল মানেক শ’র কাছে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী এক টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করতে স্বীকৃতি জানান। মানেক শ আত্মসমর্পনের সময় নির্ধারণ করে দেন।
মুক্তিযুদ্ধে পর ওসমানী :
স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতির প্রতি চরম ত্যাগ ও মহান সেবার স্বীকৃতি হিসেবে ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন যা কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীন নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন ওসমানী। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আগের দায়িত্বসহ ডাক, তার, টেলিফোন ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় (বাকশাল) রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালু হলে এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আওয়ামী লিগ ও সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করেন। ২৯ আগস্ট ১৯৭৫ সালে দেশে সামরিক শাসন চলাকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন এবং ৩ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হেরে যান। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত ওসমানী লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র : মুজিব নগর সরকারের দলিল পত্র, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান/ এএসএম সামছুল আরেফীন, মুক্তিযুদ্ধ কোষ/মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, জন্মযুদ্ধ
লেখকের কথা : তথ্যপ্রমাণেই বোঝা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জায়গায় প্রধান সেনাপতি ওসমানীর আসার প্রশ্নই ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের পর ওসমানী অবমূল্যায়িত হয়েছেন এটাও সত্যি নয়। সামহোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্লগাররা ওসমানী নিয়ে লেখেননি কথাটিও মিথ্যা। ওসমানীর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে সামহোয়ারে পোস্ট দিয়েছি আমিসহ অনেকেই। বাবার পাণ্ডুলিপি যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ ধারাবাহিকে একটি অধ্যায় ছিল ওসমানীকে নিয়ে। কেনো ওসমানীকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। মার্কিন অধিদপ্তরের প্রকাশিত দলিলপত্রে দেখা যায় যে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে যে দাবিগুলো তুলেছিল তাতে ১ নম্বরে ছিল শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি। ৩ নম্বরে বলা হয়েছে পাকিস্তানে অবস্থানরত সব বাঙালী সৈনিকের দেশে ফিরে আসার সুযোগ এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা। আগেই বলা হয়েছে যৌথ কমান্ডের নেতৃত্ব ছিলো অরোরার হাতে। বাংলাদেশের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপসেনাধ্যক্ষ একে খন্দকার। এখন কেন ছিলেন না ওসমানী- এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি থাকতে না পারার জন্য কখনও মন খারাপ করে কোনো বিবৃতি দেননি, লেখেনওনি কোথাও যা দলিলাকারে পাওয়া যাবে। একমাত্র উপায় ওসমানীর বিদেহী আত্মার সঙ্গে প্ল্যানচেটে যোগাযোগ স্থাপন। তাতেও ইতিহাসের কোনো হরফ বদলাবে না বলেই আমার ধারণা।
যে কারনে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ব্যর্থ হলাম (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত সকল সূর্য-সন্তানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সহ)
WRITTEN BY MIRZA
মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসের একটি অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ যাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ নারী পুরুষ এবং যাদের সিংহভাগই ছিলেন নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ । এর বাইরে হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছেন, যৌনদাসী হিসাবে নির্যাতিত হয়েছেন । এই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি এমনকি শিশুরাও । ১৯৪৯ সালে গৃহীত জেনেভা কনভেনশন কর্তৃক এই ধরণের ঘৃণ্য কর্মকান্ডের প্রতিটিই যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত (১) । ২০০২ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধের যে আওতা নির্ধারণ করে তার মাধ্যমেও এই অপরাধগুলি যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত । তবে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের সময় কাল ১৯৭১ হবার কারণে তা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের আওতায় আলোচনা করাই বেশী যুক্তিসংগত হবে ।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ নয় যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি তবে সম্ভবত: একমাত্র দেশ যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্বেও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাহার করেছে । আমি এখানে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের কথা বলছি । এইসব পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশীয় দোসর যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে তারা সময়ের পালাবদলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছে, এখন সময় সুযোগমত তাদের করা যুদ্ধাপরাধকেও অস্বীকার করছে । পরবর্তীতে এইসব কুলাংগারদের কথাও আসবে, এদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আমাদের ব্যর্থতার কথাও আসবে । তবে এই পোষ্টে আমি মুলত: পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা আটক ছিল, যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ ছিল, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেবার পরও কোন পরিস্থিতিতে, কি কারনে একটি নব্য-স্বাধীন দেশ তার জন্মযুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করলো তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করলো সেটি তুলে আনার চেষ্টা করবো । (২,৯)
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের পরে প্রায় ৯০,৫০০ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল প্রায় ৮০,০০০ উর্দিধারী সদস্য যার মধ্যে ছিল আর্মি (৫৫,৬৯২), নেভী ও এয়ার ফোর্স (১,৮০০), প্যারামিলিটারি (১৬,৩৫৪) বা পুলিশ সদস্য (৫,২৯৬)এবং বাদবাকী ১০,৫০০ ছিল সিভিলিয়ান (মুলত: বিহারী) যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে । (৩)
এই যুদ্ধবন্দীদের সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করে আটক রাখার মত অবকাঠামো না থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ভারত এই ৯০,৫০০ যুদ্ধবন্দীকে আটক রাখবে এবং এদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ ভরণপোষনের দায়িত্ব পালন করবে । এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের জন্য তখনকার হিসাবে প্রতিমাসে ভারতের খরচ ছিল ১,০০০,০০০ মার্কিন ডলার । (৪)
এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫০০ জনকে চিন্হিত করা হলেও চূড়ান্তভাবে সর্বমোট ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় । এবং এদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার । (৫) বাদবাকী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয় । বাংলাদেশ তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ।
পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই এবং পাকিস্তানের মিত্র রাষ্ট্র চীনের প্রদত্ত ভেটোর কারনে বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করে নাই । ১৯৭২ সালের আগষ্ট মাসে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দেয় । এটি ছিল চীনের জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রথম ভেটো । (৬)
এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫০০ জন যুদ্ধাপরাধী থেকে ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের উদ্যোগ নিল এবং জুলাই মাসে সংসদে "International Crimes Act 1973 " পাশ করলো তখন পাকিস্তান এই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো । (৭) পাকিস্তানের মতে এটি জেনেভা কনভেনশনের লংঘন কেননা বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয় ।
জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৫, ৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের এই বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগের কোন সমস্যা ছিলোনা । বাংলাদেশ পাকিস্তানের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানায় । পাকিস্তান এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে আটকে পড়া ৪০০,০০০ বাঙালীকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে । (৭)
পাকিস্তানের অবস্থান বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে । ১৯৭২ এর ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যেটি "সিমলা চুক্তি" নামে পরিচিত । এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার যুদ্ধ-বিবাদ এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে দুইপক্ষের কাছেই আটককৃত যুদ্ধবন্দী ও আটকে পড়া নাগরিকদের বিনিময় কর্মসূচী চালুর ব্যাপারে সম্মত হয় (৮) । উল্লেখ্য আটককৃত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময় আটক হলেও সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ ছিলোনা । এর প্রধান কারণ ছিলো পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোন প্রকার আলোচনায় রাজী ছিলোনা । বাংলাদেশ সিমলা চুক্তিকে স্বাগত: জানায় এবং যুদ্ধবন্দীদের রিপ্যাট্রিয়েশন চালু করার ব্যাপারে ভারতের কাছে সম্মতি প্রদান করে । (৯)
এরপর ১৯৭৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ভারত এবং বাংলাদেশ এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে বিদ্যমান হিউম্যানিট্যারিয়ান ক্রাইসিস মোকাবেলায় একটি দিক নির্দেশনা প্রদান করলো । যৌথ ঘোষনায় বলা হলো "they are resolved to continue their efforts to reduce tension, promote friendly and harmonious relationship in the sub-continent and work together towards the establishment of a durable peace ". এই ঘোষণার মাধ্যমেই ১৯৫ জন চিন্হিত যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাদ বাকী সকল যুদ্ধবন্দীর পাকিস্তানে রিপ্যাট্রিয়েশনের পথ উন্মুক্ত হলো (৯, ১০)। একই দিন রেডিও বাংলাদেশের এক ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৫ জনের বিচারের ব্যাপারে তাদের অনড় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করলো । (১১)
বাংলাদেশ এই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করে এবং ভারত সেই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে । এই অবস্থায় পাকিস্তান ভারত কর্তৃক পাকিস্তানী নাগরিক এই ১৯৫ জনকে বাংলাদেশ (যার সার্বভৌম অস্তিত্বকে তখনো পাকিস্তান স্বীকার করেনা) হস্তান্তরের পরিকল্পনার প্রতিবাদ করে এবং আটকে পড়া বাংলাদেশী নাগরিকদের পণবন্দী হিসাবে ব্যবহারের হুমকি দেয় । (৭)
এরপরও বাংলাদেশ বিচার প্রক্রিয়া চালাবার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে থাকলে ১৯৭৩ সালের ১১ই মে পাকিস্তান এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে (পাকিস্তানের ভাষায় যুদ্ধবন্দী) ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের বিপক্ষে এবং এই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত বিচার প্রক্রিয়া জেনেভা কনভেনশনের লংঘন উল্লেখ করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসে একটি মামলা দায়ের করে । মামলার নথি নম্বর ৪২৬ । এই মামলার আর্জিতে পাকিস্তান সরকার হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসের কাছে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করার নির্দেশ দান এবং বাংলাদেশে প্রস্তাবিত বিচার প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষনার দাবী জানায় । (১২)
এই আর্জিতে পাকিস্তান এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর কর্তৃত্ব দাবী করে তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে নিরপেক্ষ ও যোগ্য বিচারক এর মাধ্যমে একটি ট্রাইবুন্যাল গঠনের প্রস্তাব দেয় এবং বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালের আইনগত ভিত্তি বাতিলের দাবী জানায় । মামলার মুল নথি থেকে " Pakistan does not accept that India has a right to transfer its prisoner of wars for trial to Bangladesh and claims that by virtue of Article VI of genocide convention, persons charged with genocide shall be tried by a Competent Tribunal of the state in the territory of which the act was committed. This means that Pakistan has exclusive jurisdiction to the custody of persons accused of the crimes of genocide, since at the time acts are alleged to have been committed, the territory of East Pakistan was universally recognised as part of Pakistan.
....That a competent tribunal means a Tribunal of impartial judges, applying international law, and permitting the accused to be defended by counsel of their choice. ..... in the atmosphere of hatred that prevails in Bangladesh, such a competent tribunal cannot be created in practice....." (১১)
পাকিস্তান এই আর্জিতে সুকৌশলে যেটি এড়িয়ে যায় সেটি হলো ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ । এর ফলে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন হবার স্থল পূর্ব - পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত এবং সেই সুবাদে সকল যুদ্ধবন্দীর কর্তৃত্ব, পাকিস্তানের এই দাবীর আইনগত ভিত্তি ছিল দুর্বল । অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল জাতিসংঘের ততদিনে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান না করা ।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে এবং ভারত-পাকিস্তান উভয় পক্ষকে তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট প্রদান করার নির্দেশ দান করে । এই মামলাটি ছিলো বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করবার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। (১২)
পাকিস্তান এই মামলা করলেও ভারতের সাথে যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পনের জন্য্ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে । এবং বিপরীতে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য ট্রাইবুন্যাল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে । এর প্রাথমিক ধাপ হিসাবে সংসদে গৃহীত International Crimes Act 1973 বাংলাদেশ সরকারকে বাংলাদেশের নাগরিক ছাড়াও যে কোন দেশের নাগরিককে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের ক্ষমতা প্রদান করে ।
International Crimes Act এর মুলকপি থেকে
" It gives Bangladesh the power to try and punish any person irrespective of his nationality, who, being a member of any armed, defence or auxiliary forces commits or has committed, in the territory of Bangladesh, whether before or after the commencement of this Act, any of the following crimes… namely crimes against humanity, crimes against peace, genocide, war crimes, violations of
humanitarian rules applicable in armed conflicts laid down in the Geneva Convention of 1949 and any other crimes under international law." (১৩)
এর মাঝে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৯৭৩ সালের ১৩ই জুলাই একটি সংক্ষিপ্ত সেশনে পাকিস্তানের দায়ের করা মামলাটি আদৌ ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসের আওতার মধ্যে পড়ে কিনা তা নির্ধারণের জন্য পাকিস্তানকে ১ অক্টোবর ১৯৭৩ এবং ভারতকে তার জবাব দেবার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত সময় বেধে দেয় । (১৪)
পাকিস্তান মামলাটি মুলত: ভারতকে চাপে ফেলার জন্য করলেও মামলাটি চালাতে উৎসাহী ছিলোনা । এর চাইতে তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দিকে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে । যদিও প্রকৃত পক্ষে আলোচনা হচ্ছিল ত্রিমুখী । ভারত আর পাকিস্তানের সাথে আলোচনার পাশাপাশি সেই আলোচনার সূত্র ধরে আলোচনা হচ্ছিল ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ।
অবশেষে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯ দিন ব্যাপী আলোচনার পর বাংলাদেশের সম্মতিতে ২৮শে আগষ্ট ১৯৭৩ দিল্লীতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই তিন দেশের মধ্যে যুদ্ধবন্দী প্রত্যার্পন ও আটকে পড়া নাগরিকদের বিনিময় অবিলম্বে শুরু করার সিদ্ধান্ত হয় । এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত বাদ বাকী পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যর্পনে সম্মত হয় এবং ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন করতে অনড় থাকে । (১৫)
এই চুক্তি মোতাবেক সকল যুদ্ধবন্দীর প্রত্যর্পন সম্পন্ন হবার পর বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান প্রথমবারের মত সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর ভাগ্য নির্ধারন করতে সম্মত হয়। এই বিষয়টি নিস্পত্তির আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীরা ভারতের তত্বাবধানে থাকবে । ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ থেকে দিল্লী চুক্তি অনযায়ী যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পন এবং আটকে পড়া নাগরিক বিনিময় শুরু হয় । (৯)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত একটি বড় মাপের আন্তর্জাতিক সংস্থায় রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পান আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স এ অনুষ্ঠিত ন্যাম (নন এ্যালায়েন্স মুভমেন্ট) সম্মেলনে । ১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয় । ঐতিহ্যগতভাবে প্রায় সকল মুসলিম দেশই ন্যাম এর সদস্যরাষ্ট্র তাই জাতিসংঘের সদস্য না হবার পরও বাংলাদেশকে ন্যাম এর সদস্যপদ প্রধান করা হয় । (১৬)
এই সম্মেলনে আরব নেতৃবৃন্দের সাথে শেখ মুজিবের ফলপ্রসু আলোচনা হয় এবং আরব লীগ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট ও দেশ পুনর্গঠনে সর্বতোভাবে সহায়তার আশ্বাস দেয় । এরই সূত্র ধরে কুয়েত সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে স্বর্ণ মজুদ রাখে । এই আলোচনা ও সহযোগিতার রেশ ধরেই ৭৩ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে আরব লীগ নেতৃবুন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় । (১৭)
মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে সৌদি আরবের রাজা ফয়সাল, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেডিয়েন এর সহযোগিতায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যার মুলে ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচারে বাংলাদেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো এবং এজন্য তখনো পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই । আর পাকিস্তানের মিত্র হিসাবে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে যোগদানে ভেটো প্রদান করছে । এর মধ্যে চীন পুনরায় জানিয়ে দেয় ""After resolution of the war trials issue, Peking will recognise Dacca, and the way will be open for Bangladesh to be admitted to the United Nations" (১৮) ।
এর মাঝে আন্তর্জাতিক আদালতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী হস্তান্তর বিষয়ে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের মামলার সকল কাগজপত্র জমা দেবার তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ১৭ই মে ১৯৭৪ পর্যন্ত বর্ধিত করা হলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা নিরসনে আরব লীগ নেতৃবৃন্দের নেওয়া উদ্যোগের ফলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালত থেকে মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতের রেজিষ্ট্রারের কাছে একটি চিঠিতে পাকিস্তান মামলাটি আর না চালাবার সিদ্ধান্ত জানায় এবং মামলাটি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারাধীন মামলার তালিকা থেকে বাদ দেবার জন্য অনুরোধ জানায় । এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ এক আদেশের মাধ্যমে, আদেশ নং - ৩৯৩, এই মামলাটি বাতিল ঘোষনা করে এবং তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । (১৪)
আন্তর্জাতিক আদালত থেকে পাকিস্তানের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আরব লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয় এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা ভারতের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয় । এবার আরব লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করেন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করার জন্য । এর জবাবে জুলফিকার আলী ভূট্টো জানান যে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই কেবলমাত্র পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে ।
এই কূটনৈতিক উদ্যোগ আরো গতি লাভ করে ১৯৭৪ সালের ২২-২৪ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে । বাংলাদেশ তখনো ওআইসির সদস্য নয় । প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতি থাকা সত্বেও (ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান ব্যতীত), পাকিস্তানের আপত্তির কারণে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে । এর মধ্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের রাজা হুসেইন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেন ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজী করাতে । কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিকভাবে কোন শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতি গ্রহণে অস্বীকার করেন এবং এই বিষয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত দেন। এরপর এই প্রতিনিধিদল বৈঠক করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে । তারা সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান জানান এবং যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন । (১৯, ২১)
এর মধ্যে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে কিন্তু পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিলে ওআইসি সম্মেলনে যোগ না দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পুনরায় জানিয়ে দেয় । (২০)
এই অবস্থায় আরব লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে শেষ মুহুর্তের আলোচনায় অনেকটা নাটকীয়ভাবে ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । একই দিন ইরান এবং তুরস্কও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । (২১) তবে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকৃতি জানায় । এর মাধ্যমে পাকিস্তান আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কৌশলগত কারনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েও চীনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে না আসা পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করার ব্যাপারটি আটকে রাখে ।
২২ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভ করার পর বাংলাদেশের একই দিন থেকে লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়াতে আর কোন বাধা থাকেনা । এই অবস্থায় ২২শে ফ্রেব্রুয়ারী সকালে কুয়েতের আমীরের ভাই কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলির একটি প্রতিনিধিদল একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা আসেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এসকর্ট করে লাহোরে নিয়ে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানে রাষ্ট্রবন্দী হিসাবে আটক শেখ মুজিবুর রহমান এবার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখেন । (২০)
লাহোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আনোয়ার সাদাত, সৌদি আরবের রাজা ফয়সাল এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এর মাঝে পাকিস্তান লাহোর সম্মেলনে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে এবং এর সপক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে । (১৯, ২২)
লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয় এবং এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করে । এর রেশ ধরে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । বৈঠকে শেখ মুজিব ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং দেশে ফিরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার কথা জানান । আনোয়ার সাদাতের এই উদ্যোগ এর সাফল্য নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১১ই মে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যার টাইটেল ছিলো "The Return of the Magician" । টাইম থেকে উদ্ধৃতি "In the most dramatic event of the summit, however, Sadat was able to reconcile Pakistan's Premier Zulfikar Ali Bhutto and Bangladesh Premier Sheik Mujibur Rahman, who have been enemies since Bangladesh split off from Pakistan two years ago. Bhutto solemnly recognized the independence of Pakistan's former east wing, while Sheik Mujib hinted that he will no longer press wartime atrocity charges against 195 Pakistani officers held prisoner in India. Mujib promised also to do "my bit" to reconcile Pakistan and India, a task that would tax even Henry Kissinger." (২৩)
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য লাহোর সম্মেলন এর পরপরই একটি সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে আসেন আনোয়ার সাদাত এবং আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হউরি বুমেদিন (Houri Boummedine) । কয়েক ঘন্টার এই সফরে তারা শেখ মুজিবর রহমানের কাছ থেকে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চার্জ প্রত্যাহারের ব্যাপারে পুনরায় প্রতিশ্রুতি লাভ করেন এর বিনিময়ে তারা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দেন । বাংলাদেশে তখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে । এর একটি বড় কারন ছিলো ১৯৭৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের চলমান United Nations Relief Organization in Bangladesh (UNROB) কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া । (১৯, ২৪)
আরব লীগ ও মুসলিশ নেতৃবৃন্দকে প্রতিশ্রুতি দিলেও বাংলাদেশের পক্ষে তখন মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের সম্মতি ব্যতীত এত বড় একটি প্রধান সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন ছিল । এই অবস্থায় শেখ মুজিব চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মস্কো যান ১৯৭৪ এর মার্চ মাসে । সেখানে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে চিকিৎসাকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রীন সিগন্যাল পাবার পর তিনি সম্মতি পাবার পর তিনি দেশে ফেরেন । মস্কো থেকে ফিরে একটি সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি দিল্লী যান (২) এই ব্যাপারে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শের জন্য । ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অনাপত্তির পর, শেখ মুজিবুর রহমানের ওআইসি সম্মেলনে এবং আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে করা প্রতিশ্রুতি পূরণে আর কোন বাধা থাকেনা । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু যেই কাজটি করেননি সেটি হলো বাংলাদেশের মানুষের মতামত নেয়া এবং এই ব্যাপারে সংসদেও কোন বিল উত্থাপিত হয়নি ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলিকে সমধানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ৫ই এপ্রিল থেকে নয়াদিল্লীতে এই তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শুরু হয় । বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পক্ষে শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ আহমেদ । ৫ দিন ব্যাপী আলাপ আলোচনা চলার পর ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ঐতিহাসিক ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটি "TRIPARTITE AGREEMENT " নামে বেশী পরিচিত । এই চুক্তিতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটি নিস্পত্তির পাশাপাশি এই তিন দেশে আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যর্পনের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয় ।
এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করে নেয় । মুল চুক্তি থেকে উদ্ধৃতি "In the light of the foregoing and, in particular, having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past, the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh has decided not to proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war may be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in process of repatriation under the Delhi Agreement." (৯)
এর বিপরীতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃত যুদ্ধাপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে দু:খ প্রকাশ করেন যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারটিকে স্বীকার করে নেয়া হয় যেটি পাকিস্তান সরকার অস্বীকার করে আসছিলো । আবারো মুল চুক্তি থেকে উদ্ধৃতি "The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed" । বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপমহাদেশের দেশগুলির মধ্যকার বিরাজমান একটি কষ্টদায়ক অধ্যায়ের সমাপ্তির মুল কৃতিত্ব প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । (In a magnanimous gesture, Pakistan's Foreign Minister Ahmed gave chief credit for bringing an end to a "painful chapter" in South Asia's history to Bangladesh's Prime Minister Sheik Mujibur Rahman.) । (২)
এভাবেই ইতিহাসের ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধ সংগঠন করার পরও, তাদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্বেও এবং সকল প্রমাণাদি থাকার পরও মুক্তি পেয়ে গেল ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী । ১৯৭৪ এর ৩০শে এপ্রিল এর মধ্যে সকল যুদ্ধাপরাধী ভারত থেকে পাকিস্তানে ফেরত গেল ।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারিয়েছেন এবং সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের কাছে এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার বিষয়টি ব্যাপক হতাশা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । বিশেষ করে তৎকলীন বামপন্থী সংগঠনগুলি এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে । (২৫)
এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে উপজীব্য করে টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭৪ সালের ২২ শে এপ্রিল "End of a Bad Dream" নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে । সেখানে লাহোর সম্মেলনের পরে এই চুক্তিটিকে একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে চার্জ প্রত্যাহারকে একটি বড় ছাড় হিসাবে উল্লেখ করা হয় । একই রিপোর্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় "The trials, tribulations and conflicts of our subcontinent will become a thing of the past—something of a bad dream that is best forgotten." । (২)
কিন্তু আসলেই কি আমরা এই bad dream কে ভুলতে পেরেছি নাকি ভোলা উচিত? মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী, ধর্ষিত ও নির্যাতিত হাজার হাজার মা বোন, তোমরা আমাদের ক্ষমা করো । আমরা সহজেই অনেক কিছুই ভুলে যাই । তোমাদের উপর করা পাশবিক বীভৎসতার বিচার আমরা করতে পারিনি । তোমাদের এই অথর্ব সন্তানদের ক্ষমা করো ।
মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসের একটি অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ যাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ নারী পুরুষ এবং যাদের সিংহভাগই ছিলেন নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ । এর বাইরে হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছেন, যৌনদাসী হিসাবে নির্যাতিত হয়েছেন । এই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি এমনকি শিশুরাও । ১৯৪৯ সালে গৃহীত জেনেভা কনভেনশন কর্তৃক এই ধরণের ঘৃণ্য কর্মকান্ডের প্রতিটিই যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত (১) । ২০০২ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধের যে আওতা নির্ধারণ করে তার মাধ্যমেও এই অপরাধগুলি যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত । তবে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের সময় কাল ১৯৭১ হবার কারণে তা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের আওতায় আলোচনা করাই বেশী যুক্তিসংগত হবে ।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ নয় যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি তবে সম্ভবত: একমাত্র দেশ যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্বেও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাহার করেছে । আমি এখানে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের কথা বলছি । এইসব পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশীয় দোসর যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে তারা সময়ের পালাবদলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছে, এখন সময় সুযোগমত তাদের করা যুদ্ধাপরাধকেও অস্বীকার করছে । পরবর্তীতে এইসব কুলাংগারদের কথাও আসবে, এদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আমাদের ব্যর্থতার কথাও আসবে । তবে এই পোষ্টে আমি মুলত: পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা আটক ছিল, যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ ছিল, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেবার পরও কোন পরিস্থিতিতে, কি কারনে একটি নব্য-স্বাধীন দেশ তার জন্মযুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করলো তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করলো সেটি তুলে আনার চেষ্টা করবো । (২,৯)
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের পরে প্রায় ৯০,৫০০ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল প্রায় ৮০,০০০ উর্দিধারী সদস্য যার মধ্যে ছিল আর্মি (৫৫,৬৯২), নেভী ও এয়ার ফোর্স (১,৮০০), প্যারামিলিটারি (১৬,৩৫৪) বা পুলিশ সদস্য (৫,২৯৬)এবং বাদবাকী ১০,৫০০ ছিল সিভিলিয়ান (মুলত: বিহারী) যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে । (৩)
এই যুদ্ধবন্দীদের সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করে আটক রাখার মত অবকাঠামো না থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ভারত এই ৯০,৫০০ যুদ্ধবন্দীকে আটক রাখবে এবং এদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ ভরণপোষনের দায়িত্ব পালন করবে । এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের জন্য তখনকার হিসাবে প্রতিমাসে ভারতের খরচ ছিল ১,০০০,০০০ মার্কিন ডলার । (৪)
এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫০০ জনকে চিন্হিত করা হলেও চূড়ান্তভাবে সর্বমোট ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় । এবং এদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার । (৫) বাদবাকী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয় । বাংলাদেশ তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ।
পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই এবং পাকিস্তানের মিত্র রাষ্ট্র চীনের প্রদত্ত ভেটোর কারনে বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করে নাই । ১৯৭২ সালের আগষ্ট মাসে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দেয় । এটি ছিল চীনের জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রথম ভেটো । (৬)
এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫০০ জন যুদ্ধাপরাধী থেকে ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের উদ্যোগ নিল এবং জুলাই মাসে সংসদে "International Crimes Act 1973 " পাশ করলো তখন পাকিস্তান এই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো । (৭) পাকিস্তানের মতে এটি জেনেভা কনভেনশনের লংঘন কেননা বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয় ।
জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৫, ৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের এই বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগের কোন সমস্যা ছিলোনা । বাংলাদেশ পাকিস্তানের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানায় । পাকিস্তান এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে আটকে পড়া ৪০০,০০০ বাঙালীকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে । (৭)
পাকিস্তানের অবস্থান বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে । ১৯৭২ এর ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যেটি "সিমলা চুক্তি" নামে পরিচিত । এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার যুদ্ধ-বিবাদ এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে দুইপক্ষের কাছেই আটককৃত যুদ্ধবন্দী ও আটকে পড়া নাগরিকদের বিনিময় কর্মসূচী চালুর ব্যাপারে সম্মত হয় (৮) । উল্লেখ্য আটককৃত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময় আটক হলেও সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ ছিলোনা । এর প্রধান কারণ ছিলো পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোন প্রকার আলোচনায় রাজী ছিলোনা । বাংলাদেশ সিমলা চুক্তিকে স্বাগত: জানায় এবং যুদ্ধবন্দীদের রিপ্যাট্রিয়েশন চালু করার ব্যাপারে ভারতের কাছে সম্মতি প্রদান করে । (৯)
এরপর ১৯৭৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ভারত এবং বাংলাদেশ এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে বিদ্যমান হিউম্যানিট্যারিয়ান ক্রাইসিস মোকাবেলায় একটি দিক নির্দেশনা প্রদান করলো । যৌথ ঘোষনায় বলা হলো "they are resolved to continue their efforts to reduce tension, promote friendly and harmonious relationship in the sub-continent and work together towards the establishment of a durable peace ". এই ঘোষণার মাধ্যমেই ১৯৫ জন চিন্হিত যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাদ বাকী সকল যুদ্ধবন্দীর পাকিস্তানে রিপ্যাট্রিয়েশনের পথ উন্মুক্ত হলো (৯, ১০)। একই দিন রেডিও বাংলাদেশের এক ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৫ জনের বিচারের ব্যাপারে তাদের অনড় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করলো । (১১)
বাংলাদেশ এই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করে এবং ভারত সেই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে । এই অবস্থায় পাকিস্তান ভারত কর্তৃক পাকিস্তানী নাগরিক এই ১৯৫ জনকে বাংলাদেশ (যার সার্বভৌম অস্তিত্বকে তখনো পাকিস্তান স্বীকার করেনা) হস্তান্তরের পরিকল্পনার প্রতিবাদ করে এবং আটকে পড়া বাংলাদেশী নাগরিকদের পণবন্দী হিসাবে ব্যবহারের হুমকি দেয় । (৭)
এরপরও বাংলাদেশ বিচার প্রক্রিয়া চালাবার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে থাকলে ১৯৭৩ সালের ১১ই মে পাকিস্তান এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে (পাকিস্তানের ভাষায় যুদ্ধবন্দী) ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের বিপক্ষে এবং এই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত বিচার প্রক্রিয়া জেনেভা কনভেনশনের লংঘন উল্লেখ করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসে একটি মামলা দায়ের করে । মামলার নথি নম্বর ৪২৬ । এই মামলার আর্জিতে পাকিস্তান সরকার হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসের কাছে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করার নির্দেশ দান এবং বাংলাদেশে প্রস্তাবিত বিচার প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষনার দাবী জানায় । (১২)
এই আর্জিতে পাকিস্তান এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর কর্তৃত্ব দাবী করে তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে নিরপেক্ষ ও যোগ্য বিচারক এর মাধ্যমে একটি ট্রাইবুন্যাল গঠনের প্রস্তাব দেয় এবং বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালের আইনগত ভিত্তি বাতিলের দাবী জানায় । মামলার মুল নথি থেকে " Pakistan does not accept that India has a right to transfer its prisoner of wars for trial to Bangladesh and claims that by virtue of Article VI of genocide convention, persons charged with genocide shall be tried by a Competent Tribunal of the state in the territory of which the act was committed. This means that Pakistan has exclusive jurisdiction to the custody of persons accused of the crimes of genocide, since at the time acts are alleged to have been committed, the territory of East Pakistan was universally recognised as part of Pakistan.
....That a competent tribunal means a Tribunal of impartial judges, applying international law, and permitting the accused to be defended by counsel of their choice. ..... in the atmosphere of hatred that prevails in Bangladesh, such a competent tribunal cannot be created in practice....." (১১)
পাকিস্তান এই আর্জিতে সুকৌশলে যেটি এড়িয়ে যায় সেটি হলো ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ । এর ফলে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন হবার স্থল পূর্ব - পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত এবং সেই সুবাদে সকল যুদ্ধবন্দীর কর্তৃত্ব, পাকিস্তানের এই দাবীর আইনগত ভিত্তি ছিল দুর্বল । অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল জাতিসংঘের ততদিনে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান না করা ।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে এবং ভারত-পাকিস্তান উভয় পক্ষকে তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট প্রদান করার নির্দেশ দান করে । এই মামলাটি ছিলো বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করবার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। (১২)
পাকিস্তান এই মামলা করলেও ভারতের সাথে যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পনের জন্য্ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে । এবং বিপরীতে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য ট্রাইবুন্যাল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে । এর প্রাথমিক ধাপ হিসাবে সংসদে গৃহীত International Crimes Act 1973 বাংলাদেশ সরকারকে বাংলাদেশের নাগরিক ছাড়াও যে কোন দেশের নাগরিককে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের ক্ষমতা প্রদান করে ।
International Crimes Act এর মুলকপি থেকে
" It gives Bangladesh the power to try and punish any person irrespective of his nationality, who, being a member of any armed, defence or auxiliary forces commits or has committed, in the territory of Bangladesh, whether before or after the commencement of this Act, any of the following crimes… namely crimes against humanity, crimes against peace, genocide, war crimes, violations of
humanitarian rules applicable in armed conflicts laid down in the Geneva Convention of 1949 and any other crimes under international law." (১৩)
এর মাঝে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৯৭৩ সালের ১৩ই জুলাই একটি সংক্ষিপ্ত সেশনে পাকিস্তানের দায়ের করা মামলাটি আদৌ ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিসের আওতার মধ্যে পড়ে কিনা তা নির্ধারণের জন্য পাকিস্তানকে ১ অক্টোবর ১৯৭৩ এবং ভারতকে তার জবাব দেবার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত সময় বেধে দেয় । (১৪)
পাকিস্তান মামলাটি মুলত: ভারতকে চাপে ফেলার জন্য করলেও মামলাটি চালাতে উৎসাহী ছিলোনা । এর চাইতে তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দিকে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে । যদিও প্রকৃত পক্ষে আলোচনা হচ্ছিল ত্রিমুখী । ভারত আর পাকিস্তানের সাথে আলোচনার পাশাপাশি সেই আলোচনার সূত্র ধরে আলোচনা হচ্ছিল ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ।
অবশেষে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯ দিন ব্যাপী আলোচনার পর বাংলাদেশের সম্মতিতে ২৮শে আগষ্ট ১৯৭৩ দিল্লীতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই তিন দেশের মধ্যে যুদ্ধবন্দী প্রত্যার্পন ও আটকে পড়া নাগরিকদের বিনিময় অবিলম্বে শুরু করার সিদ্ধান্ত হয় । এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত বাদ বাকী পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যর্পনে সম্মত হয় এবং ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন করতে অনড় থাকে । (১৫)
এই চুক্তি মোতাবেক সকল যুদ্ধবন্দীর প্রত্যর্পন সম্পন্ন হবার পর বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান প্রথমবারের মত সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর ভাগ্য নির্ধারন করতে সম্মত হয়। এই বিষয়টি নিস্পত্তির আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীরা ভারতের তত্বাবধানে থাকবে । ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ থেকে দিল্লী চুক্তি অনযায়ী যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পন এবং আটকে পড়া নাগরিক বিনিময় শুরু হয় । (৯)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত একটি বড় মাপের আন্তর্জাতিক সংস্থায় রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পান আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স এ অনুষ্ঠিত ন্যাম (নন এ্যালায়েন্স মুভমেন্ট) সম্মেলনে । ১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয় । ঐতিহ্যগতভাবে প্রায় সকল মুসলিম দেশই ন্যাম এর সদস্যরাষ্ট্র তাই জাতিসংঘের সদস্য না হবার পরও বাংলাদেশকে ন্যাম এর সদস্যপদ প্রধান করা হয় । (১৬)
এই সম্মেলনে আরব নেতৃবৃন্দের সাথে শেখ মুজিবের ফলপ্রসু আলোচনা হয় এবং আরব লীগ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট ও দেশ পুনর্গঠনে সর্বতোভাবে সহায়তার আশ্বাস দেয় । এরই সূত্র ধরে কুয়েত সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে স্বর্ণ মজুদ রাখে । এই আলোচনা ও সহযোগিতার রেশ ধরেই ৭৩ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে আরব লীগ নেতৃবুন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় । (১৭)
মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে সৌদি আরবের রাজা ফয়সাল, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেডিয়েন এর সহযোগিতায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যার মুলে ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচারে বাংলাদেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো এবং এজন্য তখনো পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই । আর পাকিস্তানের মিত্র হিসাবে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে যোগদানে ভেটো প্রদান করছে । এর মধ্যে চীন পুনরায় জানিয়ে দেয় ""After resolution of the war trials issue, Peking will recognise Dacca, and the way will be open for Bangladesh to be admitted to the United Nations" (১৮) ।
এর মাঝে আন্তর্জাতিক আদালতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী হস্তান্তর বিষয়ে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের মামলার সকল কাগজপত্র জমা দেবার তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ১৭ই মে ১৯৭৪ পর্যন্ত বর্ধিত করা হলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা নিরসনে আরব লীগ নেতৃবৃন্দের নেওয়া উদ্যোগের ফলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালত থেকে মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯৭৩ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতের রেজিষ্ট্রারের কাছে একটি চিঠিতে পাকিস্তান মামলাটি আর না চালাবার সিদ্ধান্ত জানায় এবং মামলাটি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারাধীন মামলার তালিকা থেকে বাদ দেবার জন্য অনুরোধ জানায় । এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাষ্টিস ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ এক আদেশের মাধ্যমে, আদেশ নং - ৩৯৩, এই মামলাটি বাতিল ঘোষনা করে এবং তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । (১৪)
আন্তর্জাতিক আদালত থেকে পাকিস্তানের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আরব লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয় এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা ভারতের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয় । এবার আরব লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করেন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করার জন্য । এর জবাবে জুলফিকার আলী ভূট্টো জানান যে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই কেবলমাত্র পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে ।
এই কূটনৈতিক উদ্যোগ আরো গতি লাভ করে ১৯৭৪ সালের ২২-২৪ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে । বাংলাদেশ তখনো ওআইসির সদস্য নয় । প্রায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতি থাকা সত্বেও (ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান ব্যতীত), পাকিস্তানের আপত্তির কারণে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে । এর মধ্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের রাজা হুসেইন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেন ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজী করাতে । কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিকভাবে কোন শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতি গ্রহণে অস্বীকার করেন এবং এই বিষয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত দেন। এরপর এই প্রতিনিধিদল বৈঠক করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে । তারা সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান জানান এবং যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন । (১৯, ২১)
এর মধ্যে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে কিন্তু পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিলে ওআইসি সম্মেলনে যোগ না দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পুনরায় জানিয়ে দেয় । (২০)
এই অবস্থায় আরব লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে শেষ মুহুর্তের আলোচনায় অনেকটা নাটকীয়ভাবে ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । একই দিন ইরান এবং তুরস্কও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে । (২১) তবে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও যুদ্ধাপরাধী সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকৃতি জানায় । এর মাধ্যমে পাকিস্তান আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কৌশলগত কারনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েও চীনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে না আসা পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করার ব্যাপারটি আটকে রাখে ।
২২ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভ করার পর বাংলাদেশের একই দিন থেকে লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়াতে আর কোন বাধা থাকেনা । এই অবস্থায় ২২শে ফ্রেব্রুয়ারী সকালে কুয়েতের আমীরের ভাই কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলির একটি প্রতিনিধিদল একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা আসেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এসকর্ট করে লাহোরে নিয়ে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য । ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানে রাষ্ট্রবন্দী হিসাবে আটক শেখ মুজিবুর রহমান এবার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখেন । (২০)
লাহোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আনোয়ার সাদাত, সৌদি আরবের রাজা ফয়সাল এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এর মাঝে পাকিস্তান লাহোর সম্মেলনে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে এবং এর সপক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে । (১৯, ২২)
লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে আরব লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয় এবং এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করে । এর রেশ ধরে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । বৈঠকে শেখ মুজিব ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং দেশে ফিরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার কথা জানান । আনোয়ার সাদাতের এই উদ্যোগ এর সাফল্য নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১১ই মে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যার টাইটেল ছিলো "The Return of the Magician" । টাইম থেকে উদ্ধৃতি "In the most dramatic event of the summit, however, Sadat was able to reconcile Pakistan's Premier Zulfikar Ali Bhutto and Bangladesh Premier Sheik Mujibur Rahman, who have been enemies since Bangladesh split off from Pakistan two years ago. Bhutto solemnly recognized the independence of Pakistan's former east wing, while Sheik Mujib hinted that he will no longer press wartime atrocity charges against 195 Pakistani officers held prisoner in India. Mujib promised also to do "my bit" to reconcile Pakistan and India, a task that would tax even Henry Kissinger." (২৩)
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য লাহোর সম্মেলন এর পরপরই একটি সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে আসেন আনোয়ার সাদাত এবং আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হউরি বুমেদিন (Houri Boummedine) । কয়েক ঘন্টার এই সফরে তারা শেখ মুজিবর রহমানের কাছ থেকে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চার্জ প্রত্যাহারের ব্যাপারে পুনরায় প্রতিশ্রুতি লাভ করেন এর বিনিময়ে তারা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দেন । বাংলাদেশে তখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে । এর একটি বড় কারন ছিলো ১৯৭৩ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের চলমান United Nations Relief Organization in Bangladesh (UNROB) কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া । (১৯, ২৪)
আরব লীগ ও মুসলিশ নেতৃবৃন্দকে প্রতিশ্রুতি দিলেও বাংলাদেশের পক্ষে তখন মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের সম্মতি ব্যতীত এত বড় একটি প্রধান সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন ছিল । এই অবস্থায় শেখ মুজিব চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মস্কো যান ১৯৭৪ এর মার্চ মাসে । সেখানে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে চিকিৎসাকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রীন সিগন্যাল পাবার পর তিনি সম্মতি পাবার পর তিনি দেশে ফেরেন । মস্কো থেকে ফিরে একটি সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি দিল্লী যান (২) এই ব্যাপারে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শের জন্য । ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অনাপত্তির পর, শেখ মুজিবুর রহমানের ওআইসি সম্মেলনে এবং আরব লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে করা প্রতিশ্রুতি পূরণে আর কোন বাধা থাকেনা । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু যেই কাজটি করেননি সেটি হলো বাংলাদেশের মানুষের মতামত নেয়া এবং এই ব্যাপারে সংসদেও কোন বিল উত্থাপিত হয়নি ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলিকে সমধানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ৫ই এপ্রিল থেকে নয়াদিল্লীতে এই তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শুরু হয় । বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পক্ষে শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ আহমেদ । ৫ দিন ব্যাপী আলাপ আলোচনা চলার পর ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ঐতিহাসিক ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটি "TRIPARTITE AGREEMENT " নামে বেশী পরিচিত । এই চুক্তিতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটি নিস্পত্তির পাশাপাশি এই তিন দেশে আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যর্পনের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয় ।
এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করে নেয় । মুল চুক্তি থেকে উদ্ধৃতি "In the light of the foregoing and, in particular, having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past, the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh has decided not to proceed with the trials as an act of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war may be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in process of repatriation under the Delhi Agreement." (৯)
এর বিপরীতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃত যুদ্ধাপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে দু:খ প্রকাশ করেন যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারটিকে স্বীকার করে নেয়া হয় যেটি পাকিস্তান সরকার অস্বীকার করে আসছিলো । আবারো মুল চুক্তি থেকে উদ্ধৃতি "The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed" । বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপমহাদেশের দেশগুলির মধ্যকার বিরাজমান একটি কষ্টদায়ক অধ্যায়ের সমাপ্তির মুল কৃতিত্ব প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । (In a magnanimous gesture, Pakistan's Foreign Minister Ahmed gave chief credit for bringing an end to a "painful chapter" in South Asia's history to Bangladesh's Prime Minister Sheik Mujibur Rahman.) । (২)
এভাবেই ইতিহাসের ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধ সংগঠন করার পরও, তাদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্বেও এবং সকল প্রমাণাদি থাকার পরও মুক্তি পেয়ে গেল ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী । ১৯৭৪ এর ৩০শে এপ্রিল এর মধ্যে সকল যুদ্ধাপরাধী ভারত থেকে পাকিস্তানে ফেরত গেল ।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারিয়েছেন এবং সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের কাছে এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার বিষয়টি ব্যাপক হতাশা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । বিশেষ করে তৎকলীন বামপন্থী সংগঠনগুলি এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে । (২৫)
এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে উপজীব্য করে টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭৪ সালের ২২ শে এপ্রিল "End of a Bad Dream" নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে । সেখানে লাহোর সম্মেলনের পরে এই চুক্তিটিকে একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে চার্জ প্রত্যাহারকে একটি বড় ছাড় হিসাবে উল্লেখ করা হয় । একই রিপোর্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় "The trials, tribulations and conflicts of our subcontinent will become a thing of the past—something of a bad dream that is best forgotten." । (২)
কিন্তু আসলেই কি আমরা এই bad dream কে ভুলতে পেরেছি নাকি ভোলা উচিত? মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী, ধর্ষিত ও নির্যাতিত হাজার হাজার মা বোন, তোমরা আমাদের ক্ষমা করো । আমরা সহজেই অনেক কিছুই ভুলে যাই । তোমাদের উপর করা পাশবিক বীভৎসতার বিচার আমরা করতে পারিনি । তোমাদের এই অথর্ব সন্তানদের ক্ষমা করো ।
A man who had 2 wife (Khaleda & Hasina)
অনেক আগে একটা কৌতুক পড়েছিলাম এক লোকের ছিল দুই বউ।বউ দুজনের মধ্যে সারাখ্খন ঝগড়া লেগে থাকত। লোকটার ছিল শরীর টিপানোর অভ্যাস।দুই বউ এক সাথে লোকটার শরীর টিপতো। সেখানেও তারা ঝগড়া করতো কে শরীরের কোন অংগ টিপবে।প্রতিদিন এই নিয়ে দুজনের ঝগড়া দেখে , লোকটা একদিন দুজনকে ভাগ করে দিল কে কোথায় টিপবে।বড় বউকে দিল ডান হাত ডান পা।ছোট বউকে দিল বাম হাত বাম পা।যাই হোক কিছুদিন ভাল ভাবে সব চলল।একদিন বড় বউ শরীর টিপার জন্য তেলের বাটি(কাসার বাটি)হাতে নিয়ে লোকটার বাম দিক দিয়ে ডান দিকে যাওয়ার সময় হটাৎ হাত থেকে কাসার বাটিটা লোকটার বাম পায়ের উপর পড়ে গেল।ভারী বাটিটা গরম তেলসহ লোকটার বাম পায়ের উপর পড়া মাত্রই লোকটা চিৎকার করে উঠল।লোকটার চিৎকার শুনে ছোট বউ দৌড়ে এল।ঘটনা জানতে পেরে স্বামির ব্যাথার প্রতি সহানুভূতী দেখানোর বদলে বড় বউয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিল।
ঃকি ব্যাপার আপনি আমার ভাগের পায়ের উপর কেন বাটি ফেললেন?
এই বলে সে তার হাতের ভারী কাসার বাটিটা লোকটির ডান পায়ের উপর ফেলল।ডান পায়ের উপর বাটিটা পড়া মাত্র লোকটা মরন চিৎকার দিয়ে উঠল।বড়বউ ছোট বউয়ের কান্ড দেখে দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল।
ঃতোকে বললাম হঠাৎ পড়ে গেছে তারপরও তুই আমার পায়ের উপর বাটি ফেললি তবে এই দেখ এবার দেখে মারলাম ।
এই বলে হাতের লাঠি উচিয়ে লোকটার বাম হাতে দিল এক বাড়ি ।হতভাগ্য লোকটার বাম হাতটা ভেংগে গেল।লোকটার এখন মরন দশা।দুই বউয়ের এসব দেখার সময় নাই।ভাগের বাম হাত ভাংগতে দেখে ছোট বউ হুশ হারা হয়ে গেল।সেও এবার দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল।মৃত প্রায় লোকটার ডান হাতে মারল এক বাড়ি।
এভাবে জিতাজিতি করে মারতে দুই বউয়ে লোকটাকে মেরেই ফেলল।
দুজনে বিধবা হয়ে গেল।তারপরও ওদের ঝগড়া থামেনি পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে আর বলছে তোর কারনে স্বামিটা মরল।
পাঠক আমাদের দেশটাও কি আজ এই লোকটার মত নয় কি?প্রধান দুই দলের কোন্দলে মৃতপ্রায়।দলীয় চিৎকারে দেশের উন্নতিই শুনতে পাই বাস্তবে তার দেখা পাই না।শস্য শ্যামলা এই ঊর্বর ভূমিতে কিসের অভাব?নদী ভরা মাছ,মাঠ ভরা ফসল পৃথিবীর কয়টা দেশে আছে?তারপরও আজ আমরা তৃতী্য বিশ্বের কাতারে।কেন??? এর কোন জবাব আছে কি?
ঃকি ব্যাপার আপনি আমার ভাগের পায়ের উপর কেন বাটি ফেললেন?
এই বলে সে তার হাতের ভারী কাসার বাটিটা লোকটির ডান পায়ের উপর ফেলল।ডান পায়ের উপর বাটিটা পড়া মাত্র লোকটা মরন চিৎকার দিয়ে উঠল।বড়বউ ছোট বউয়ের কান্ড দেখে দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল।
ঃতোকে বললাম হঠাৎ পড়ে গেছে তারপরও তুই আমার পায়ের উপর বাটি ফেললি তবে এই দেখ এবার দেখে মারলাম ।
এই বলে হাতের লাঠি উচিয়ে লোকটার বাম হাতে দিল এক বাড়ি ।হতভাগ্য লোকটার বাম হাতটা ভেংগে গেল।লোকটার এখন মরন দশা।দুই বউয়ের এসব দেখার সময় নাই।ভাগের বাম হাত ভাংগতে দেখে ছোট বউ হুশ হারা হয়ে গেল।সেও এবার দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল।মৃত প্রায় লোকটার ডান হাতে মারল এক বাড়ি।
এভাবে জিতাজিতি করে মারতে দুই বউয়ে লোকটাকে মেরেই ফেলল।
দুজনে বিধবা হয়ে গেল।তারপরও ওদের ঝগড়া থামেনি পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে আর বলছে তোর কারনে স্বামিটা মরল।
পাঠক আমাদের দেশটাও কি আজ এই লোকটার মত নয় কি?প্রধান দুই দলের কোন্দলে মৃতপ্রায়।দলীয় চিৎকারে দেশের উন্নতিই শুনতে পাই বাস্তবে তার দেখা পাই না।শস্য শ্যামলা এই ঊর্বর ভূমিতে কিসের অভাব?নদী ভরা মাছ,মাঠ ভরা ফসল পৃথিবীর কয়টা দেশে আছে?তারপরও আজ আমরা তৃতী্য বিশ্বের কাতারে।কেন??? এর কোন জবাব আছে কি?
Date of Birth(DOB) of "Begum Khaleda Zia"
From Authentic documents:
1. September,5,1946: From the records of Dhaka Board, she was admitted "matriculation" exam from "Dinajpur Sadar Girls' School" in 1961 and was FAILED by 3 subjects out of 7 Subjects.
2. August,19,1947: According to the Oath of Govt. Information Details(Jatio Tottho Biboroni),
(BASOS= BD Songbad Songstha).
3. August,15,1947: Press Secretary from her own.
4. August,9,1944: According to the Marriage Certificates(kabinnama) with Capt. Ziaur Rahman
1. September,5,1946: From the records of Dhaka Board, she was admitted "matriculation" exam from "Dinajpur Sadar Girls' School" in 1961 and was FAILED by 3 subjects out of 7 Subjects.
2. August,19,1947: According to the Oath of Govt. Information Details(Jatio Tottho Biboroni),
(BASOS= BD Songbad Songstha).
3. August,15,1947: Press Secretary from her own.
4. August,9,1944: According to the Marriage Certificates(kabinnama) with Capt. Ziaur Rahman
Satire(Short Story)........(Collected)
মেয়েটার নাম না হয় নাই নিলাম। নাম নেওয়াতে সমস্যা অবশ্য নাই। এমনিতেই যা অবস্থা কিন্তু তাই বলে লেখালেখিতে তার নাম নেওয়াটাও কেমন দেখায়। অবস্থাও এমন বেগতিক যে এরকম লেখা হালকা কথায় লেখাটাও ঝামেলা। কিন্তু আমার যে লিখতে ইচ্ছে করছে। আবার কীর্তিমান লেখকদের মত লেখালেখির সাগর থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে আনার মত যোগ্য লেখকও আমি নই। তারপরেও দেখি কতদূর বলতে পারি।
ঘটনা কোথেকেশুরু করব ঠিক বুঝতে পারছিনা। গ্রামের সালিসীর বিষয়টা আনা যায়। গ্রামে সালিসী বসেছে। অপরাধী ৬ জন। সমস্যা হল স্বাক্ষী নেই। ৬ জন একটা অপরাধ করেছে স্বাক্ষী নেই কেন? কারন ৬ জনই অপরাধী। এমন কথা যিনি বললেন সেই সাবের মোয়াজ্জেন যা বলেন তাকে বলা হয় ফতোয়া। এমন নাম কেন দেওয়া হবে তাও বোঝা যাচ্ছেনা। তবে সাবের যা বলে সাধারনত সেটাকে বলে ফতোয়া। পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্বাক্ষী লাগবে ৪ জন। ধর্ষনের যে কোন অপরাধ প্রমান করতে গেলে স্বাক্ষী লাগবে ৪ জন। তা ৬ জনের মধ্যে দুইজন সেই বাহাদুরির কাজ করলে বাকি ৪ জনকে স্বাক্ষি ধরা যেত কিন্তু এরুপ বীরত্বের কাজ থেকে কেই বা বিরত থাকে। তাই স্বাক্ষী নেই। অপরাধী ৬ জন।
শরীরের উপর যে ধর্ষন চলে তার দাগ হয়তবা কখনও মুছে যায়। কিন্তু মনের ধর্ষন? সেই স্মৃতি সেই বিভীষিকা? অতঃপর গ্রামবাসীরা মিলে ঠিক করল মেয়েটাকে আবার ধর্ষন করার জন্য!? কিভাবে ধর্ষন হয়েছে ৬ জনের মধ্যে কে কখন কোথায় ছিল সে সব নাকি সালিসে বলতে হবে। না হলে ধর্ষনের বিচার হবেনা। ঘটনার বিবরন ছাড়া আবার বিচার কি?? বীরত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনকারীর একজন আবার জাকির চেয়ারম্যানের ছেলে কিনা। তাই বিচারকার্য কত তাড়াতাড়ি সারা যায়।
তা জাকির চেয়ারম্যান দেখা যাচ্ছে বেশ লোক ভাল। তিনি সালিসীতে এসে বললেন, আমার ছেলেকে বাসায় গিয়ে দুই গালে দুইটা থাপ্পর দিসি। বলসি, কত বড় সাহস তোর! আমি গ্রামের চেয়ারম্যান আর তুই কিনা গ্রামে...! ওরে বাবা। দুই গালে দুই থাপ্পর? এরপর আবার বিচারের প্রয়োজন ছিল নাকি!! সুবিচার তো হয়েই গেল। জাকির চেয়ারম্যানের ভাতিজা ছিল একজন। সেও ৬ জনের টিমে ছিল। তাকেও কয় থাপ্পর মারা হয়েছে জানা যায়নি। আশা করি বেশি মারেনায়। ন্যায় পেতে গিয়ে আবার অন্যায় না হয়ে যায়। পুলিশ প্রশাসনে দূর থেকে সেই ব্যাবস্থা করা হয়েছে। নিজেদের এলাকায় আবার এসব কি?
মেয়ের বাবা ক্ষেতে কাজ করে। নাম রুহুল মিয়া। তা বলি ও রুহুল। তোমার মেয়েকে একটু বলবানা ঠিকঠাক মত জানি চলাফেরা করে। এইসব অঘটন ঘটতে দাও কেন?
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝলনা। তার হাতে কোদাল। সালিসে কোদাল আনার অর্থ বোঝা গেলনা!! সম্ভবত সালিসী থেকে ক্ষেতে কাজ করতে যাবে। মেয়ে ধর্ষনের মত সামান্য ব্যাপারে কি আর দৈনন্দিন কাজ থেমে থাকে?
রুহুল মিয়া জবাব দাও না কেন!! ছেলেপেলেকে লাই দিলে তো এরকম করবে। না বলতেসিনা যে আমাদের ছেলেরা ঠিক ছিল। কিন্তু তোমার মেয়েকে তুমি দেখে রাখোনাই ক্যান?
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝলনা। মেয়েকে তো ঘরেই রাখতে চাইসিল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ায় বিয়ে দিয়ে দিবে। সেরকম ঠিকই ছিল। মাস্টার এসে বলে মেয়েকে তোমার পড়ালেখা করাও। দেখো তার হাতের লেখা। রুহুল মিয়া বুঝলনা হাতের লেখা কি ধুইয়া পানি খাওয়ার জিনিষ কিনা। সে বলল মেয়েদের এত পড়ালেখার দরকার নাই। মাস্টারের পীড়াপিড়িতে এরকম হইসে।
রুহুল মিয়া বলে, মেয়ে তো আমার খালি স্কুল যাইত আর আসত। মাথা নিচু থাকত। আপনার ছাও তার সাথে এমনডা করল।
আরে আরে ছেলে মানুষ একটু আধটু এমনটা করেই। তাই বলে আমরা তো আসি নাকি? আমরা থাকতে তুমি পুলিশকে জানাইতে গেলা!! ব্যাপারটা ঠিক করলানা মিয়া।
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝে পেল না, না না আমি কখনই কিছু ঠিক করিনা। আমার মেয়েরে ওইদিন বললাম তোর কলম তুই কিনে আনগে এটাও ঠিক করিনাই।
হা, এটাই তো তোমারে বলতে চাই মিয়া। সন্ধ্যাকালীন মেয়েছেলেরে তুমি বাইরে পাঠাইলা ক্যান।
রুহুল মিয়ার দৃষ্টি তখন শূন্যে। বলতে লাগল, আমি গেসিলাম মোল্লাবাড়ি বর্গার টাকা আনতে। কাশেম মোল্লা বলি দিছে টাইম মত আসতে। এর মধ্যে মেয়ে আমার বলে সে নাকি বিত্তি পরীক্ষা দিবে। তার কলম নাই। আমি রাগ করি বললাম নিজেরটা নিজে কিনি আন। আমার ভুল হইসে।
এই যে দেখো ভুল খালি আমাদের ছেলেদের না। তোমারও আসে। তাইলে চল মিটমাট করে ফেলি। নিজেদের ব্যাপার পুলিশ ডেকে কি হবে? কি বলেন সবাই?
রুহুল মিয়া চুপ থাকল।
শুনেনে সবাই। আমি জাকির চেয়ারম্যান কখনও নাইনসাফি করিনা। যে ৬ জন ছিল। তাদের মধ্যে একজন আমার ছেলে একজন ভাতিজা। সবাই বুঝার চেস্টা করেন মেয়েরও দোষ ছিল। হুজুরকে জিজ্ঞেস করেন দোররা মারার কথা তিনি বলসেন। কিন্তু ভুল একটা হয়ে গেসে। মেয়েটা বাচ্চা মেয়ে। আমরা ক্ষমা করে দিলাম। আর ছয়জন সবাই ৫ হাজার টাকা করে দিবে।
রুহুল মিয়া একবার তাকাল খালি। চোখ দিয়ে পানিও আসছেনা। দৃষ্টি শূণ্য।
জাকির চেয়ারম্যান বলতে লাগল, তবে পুলিশে খবর দিসে রুহুল মিয়া। রুহুল মিয়া কাজটা ভাল করেনায়। পুলিশ হয়ত আসবে। তবে আপনারা বলে দিবেন সব সামলায় নিসি। রুহুল মিয়া নিজেই বলবে। কি বল রুহুল মিয়া? আর হা ঐ ৬ জন ছেলে যারা ভুল করসে তাদের এখানে আজকে আসার কথা ছিল তারা আসেনায়। তবে তাদের অভিভাবকরা আসছে। আপনারা জেনে রাখেন জরিমানার কথা।
রুহুল মিয়া তাকাল। অভিভাবক!। ৬ জনের ২ জন জাকির চেয়ারম্যানের ছেলে আর ভাতিজা। একজন করিম মওলার ছেলে। করিম মওলা আসছে। একজন রহমত শেখ এর ভাই। রহমত শেখ উঠে দাড়াল।
রুহুল মিয়ার কাছে আমি ২ হাজার টাকা পাই। তাই আমি ৩ হাজার দিব। করিম মওলা বলল, আমি পুরাটা একবারে দিতে পারবনা। কিস্তিতে ৫ মাসে এক হাজার করে দিব।
রুহুল মিয়া চোখ বন্ধ করে আবার খুলল।
জাকির চেয়ারম্যান। পুলিশ আসবে আর ৩০ মিনিটের মধ্যে। আমি তারে বলে দিব ঐ ৬ জনকে যাতে না খুঁজে।
জাকির চেয়ারম্যান বলল, এই তো মিয়া তুমি হইলা আমাদের ভাইয়ের মত।
রুহুল মিয়া বলল, পুলিশকে আমি ঐ ৬ জনের জন্য আসতে বলিনাই। পুলিশ এসে আমাকে ধরবে।
জাকির চেয়ারম্যান রুহুল মিয়ার দিকে তাকাল। রুহুলের চোখ পুরা লাল বর্ন।
রুহুল মিয়া বলল, এই যে কোদালখানি দেখতেস? এটা দিয়া ৬ জনের কল্লা আলাদা করসি। ৪ জন এক সাথেই ছিল। রহমতের ভাইরে খালি বাজারের পিছনের ক্ষেতে নিয়ে গেসিলাম।
সবাই উৎকন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি কয়!!
জাকির চেয়ারম্যান। আমার মেয়ে নাই। আমার মেয়ে বিত্তি পরীক্ষা দিতে চাইসিল। আমার মেয়ে কুয়ায় ঝাপ দিসে কালকে রাতে। আমি কোদালটা হাতে নিসি। আর নামাইনাই।
হটাৎ গ্রামে হৈ চৈ শুরু হল। ঝিলের ধারে, ক্ষেতে সহ ৬ জনকে পাওয়া গেসে। লাশ অবস্থায়।
জাকির চেয়ারম্যান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। রুহুল মিয়ার দিকে সবাই তাকিয়ে কিন্তু কেউ এগুতে সাহস পাচ্ছেনা। হাতের কোদালটার কারনে। এই কোদাল ৬ জনের জান নিয়েছে।
জাকির চেয়ারম্যান রুহুলের শার্টের কলার ধরল। রুহুল মিয়া বলে, চেয়ারম্যান। কোদালটা এখনও নামাইনাই। তোরে মারা বাকি আসে। সবাই কিছু বুঝার আগেই রুহুল এলোপাথারি ভাবে ৪-৫ টা কোপ দিল। জাকির চেয়ারম্যান গোঙ্গাতে লাগল।
রুহুল মিয়া তার নিজের মেয়ের মৃত্যুতে কাঁদেনায় কথাটা সত্যিনা। কেঁদেছিল পুলিশ আসার পরে। পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত রুহুল মিয়া কোদাল হাতে জাকির চেয়ারম্যানের নিথর দেহের সামনেই পড়ে ছিল। এক ফোটাও নড়েনি। গ্রামের সবাই তাকিয়ে দেখেছে কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। রুহুল মিয়ার পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে সে জাকির মিয়ার মেয়েকেও মারতে চেয়েছিল। কিন্তু অপরাধ যে করেনি তাকে আর মারা হয়নি। কোদাল চালানোর সময় তার মনে হয় ঐ মেয়ের চোখ তার নিজের মেয়ের চোখের মতই।
রুহুল মিয়ার ফাসি হয়নি। ২০ বছর জেলে থাকার পর সে ছাড়া পায়। সে জানি জেল থেকে মুক্তি পায় সে ব্যাবস্থা করার পেছনে নাকি জাকির চেয়ারম্যানের মেয়ের হাত ছিল। বাবা আর ভাই খারাপ হলেই যে মেয়ে খারাপ হবে ব্যাপারটা সব সময় এমন হয়না।
http://www.facebook.com/note.php?note_id=490995403359
ঘটনা কোথেকেশুরু করব ঠিক বুঝতে পারছিনা। গ্রামের সালিসীর বিষয়টা আনা যায়। গ্রামে সালিসী বসেছে। অপরাধী ৬ জন। সমস্যা হল স্বাক্ষী নেই। ৬ জন একটা অপরাধ করেছে স্বাক্ষী নেই কেন? কারন ৬ জনই অপরাধী। এমন কথা যিনি বললেন সেই সাবের মোয়াজ্জেন যা বলেন তাকে বলা হয় ফতোয়া। এমন নাম কেন দেওয়া হবে তাও বোঝা যাচ্ছেনা। তবে সাবের যা বলে সাধারনত সেটাকে বলে ফতোয়া। পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্বাক্ষী লাগবে ৪ জন। ধর্ষনের যে কোন অপরাধ প্রমান করতে গেলে স্বাক্ষী লাগবে ৪ জন। তা ৬ জনের মধ্যে দুইজন সেই বাহাদুরির কাজ করলে বাকি ৪ জনকে স্বাক্ষি ধরা যেত কিন্তু এরুপ বীরত্বের কাজ থেকে কেই বা বিরত থাকে। তাই স্বাক্ষী নেই। অপরাধী ৬ জন।
শরীরের উপর যে ধর্ষন চলে তার দাগ হয়তবা কখনও মুছে যায়। কিন্তু মনের ধর্ষন? সেই স্মৃতি সেই বিভীষিকা? অতঃপর গ্রামবাসীরা মিলে ঠিক করল মেয়েটাকে আবার ধর্ষন করার জন্য!? কিভাবে ধর্ষন হয়েছে ৬ জনের মধ্যে কে কখন কোথায় ছিল সে সব নাকি সালিসে বলতে হবে। না হলে ধর্ষনের বিচার হবেনা। ঘটনার বিবরন ছাড়া আবার বিচার কি?? বীরত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনকারীর একজন আবার জাকির চেয়ারম্যানের ছেলে কিনা। তাই বিচারকার্য কত তাড়াতাড়ি সারা যায়।
তা জাকির চেয়ারম্যান দেখা যাচ্ছে বেশ লোক ভাল। তিনি সালিসীতে এসে বললেন, আমার ছেলেকে বাসায় গিয়ে দুই গালে দুইটা থাপ্পর দিসি। বলসি, কত বড় সাহস তোর! আমি গ্রামের চেয়ারম্যান আর তুই কিনা গ্রামে...! ওরে বাবা। দুই গালে দুই থাপ্পর? এরপর আবার বিচারের প্রয়োজন ছিল নাকি!! সুবিচার তো হয়েই গেল। জাকির চেয়ারম্যানের ভাতিজা ছিল একজন। সেও ৬ জনের টিমে ছিল। তাকেও কয় থাপ্পর মারা হয়েছে জানা যায়নি। আশা করি বেশি মারেনায়। ন্যায় পেতে গিয়ে আবার অন্যায় না হয়ে যায়। পুলিশ প্রশাসনে দূর থেকে সেই ব্যাবস্থা করা হয়েছে। নিজেদের এলাকায় আবার এসব কি?
মেয়ের বাবা ক্ষেতে কাজ করে। নাম রুহুল মিয়া। তা বলি ও রুহুল। তোমার মেয়েকে একটু বলবানা ঠিকঠাক মত জানি চলাফেরা করে। এইসব অঘটন ঘটতে দাও কেন?
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝলনা। তার হাতে কোদাল। সালিসে কোদাল আনার অর্থ বোঝা গেলনা!! সম্ভবত সালিসী থেকে ক্ষেতে কাজ করতে যাবে। মেয়ে ধর্ষনের মত সামান্য ব্যাপারে কি আর দৈনন্দিন কাজ থেমে থাকে?
রুহুল মিয়া জবাব দাও না কেন!! ছেলেপেলেকে লাই দিলে তো এরকম করবে। না বলতেসিনা যে আমাদের ছেলেরা ঠিক ছিল। কিন্তু তোমার মেয়েকে তুমি দেখে রাখোনাই ক্যান?
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝলনা। মেয়েকে তো ঘরেই রাখতে চাইসিল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ায় বিয়ে দিয়ে দিবে। সেরকম ঠিকই ছিল। মাস্টার এসে বলে মেয়েকে তোমার পড়ালেখা করাও। দেখো তার হাতের লেখা। রুহুল মিয়া বুঝলনা হাতের লেখা কি ধুইয়া পানি খাওয়ার জিনিষ কিনা। সে বলল মেয়েদের এত পড়ালেখার দরকার নাই। মাস্টারের পীড়াপিড়িতে এরকম হইসে।
রুহুল মিয়া বলে, মেয়ে তো আমার খালি স্কুল যাইত আর আসত। মাথা নিচু থাকত। আপনার ছাও তার সাথে এমনডা করল।
আরে আরে ছেলে মানুষ একটু আধটু এমনটা করেই। তাই বলে আমরা তো আসি নাকি? আমরা থাকতে তুমি পুলিশকে জানাইতে গেলা!! ব্যাপারটা ঠিক করলানা মিয়া।
রুহুল মিয়া কি বলবে বুঝে পেল না, না না আমি কখনই কিছু ঠিক করিনা। আমার মেয়েরে ওইদিন বললাম তোর কলম তুই কিনে আনগে এটাও ঠিক করিনাই।
হা, এটাই তো তোমারে বলতে চাই মিয়া। সন্ধ্যাকালীন মেয়েছেলেরে তুমি বাইরে পাঠাইলা ক্যান।
রুহুল মিয়ার দৃষ্টি তখন শূন্যে। বলতে লাগল, আমি গেসিলাম মোল্লাবাড়ি বর্গার টাকা আনতে। কাশেম মোল্লা বলি দিছে টাইম মত আসতে। এর মধ্যে মেয়ে আমার বলে সে নাকি বিত্তি পরীক্ষা দিবে। তার কলম নাই। আমি রাগ করি বললাম নিজেরটা নিজে কিনি আন। আমার ভুল হইসে।
এই যে দেখো ভুল খালি আমাদের ছেলেদের না। তোমারও আসে। তাইলে চল মিটমাট করে ফেলি। নিজেদের ব্যাপার পুলিশ ডেকে কি হবে? কি বলেন সবাই?
রুহুল মিয়া চুপ থাকল।
শুনেনে সবাই। আমি জাকির চেয়ারম্যান কখনও নাইনসাফি করিনা। যে ৬ জন ছিল। তাদের মধ্যে একজন আমার ছেলে একজন ভাতিজা। সবাই বুঝার চেস্টা করেন মেয়েরও দোষ ছিল। হুজুরকে জিজ্ঞেস করেন দোররা মারার কথা তিনি বলসেন। কিন্তু ভুল একটা হয়ে গেসে। মেয়েটা বাচ্চা মেয়ে। আমরা ক্ষমা করে দিলাম। আর ছয়জন সবাই ৫ হাজার টাকা করে দিবে।
রুহুল মিয়া একবার তাকাল খালি। চোখ দিয়ে পানিও আসছেনা। দৃষ্টি শূণ্য।
জাকির চেয়ারম্যান বলতে লাগল, তবে পুলিশে খবর দিসে রুহুল মিয়া। রুহুল মিয়া কাজটা ভাল করেনায়। পুলিশ হয়ত আসবে। তবে আপনারা বলে দিবেন সব সামলায় নিসি। রুহুল মিয়া নিজেই বলবে। কি বল রুহুল মিয়া? আর হা ঐ ৬ জন ছেলে যারা ভুল করসে তাদের এখানে আজকে আসার কথা ছিল তারা আসেনায়। তবে তাদের অভিভাবকরা আসছে। আপনারা জেনে রাখেন জরিমানার কথা।
রুহুল মিয়া তাকাল। অভিভাবক!। ৬ জনের ২ জন জাকির চেয়ারম্যানের ছেলে আর ভাতিজা। একজন করিম মওলার ছেলে। করিম মওলা আসছে। একজন রহমত শেখ এর ভাই। রহমত শেখ উঠে দাড়াল।
রুহুল মিয়ার কাছে আমি ২ হাজার টাকা পাই। তাই আমি ৩ হাজার দিব। করিম মওলা বলল, আমি পুরাটা একবারে দিতে পারবনা। কিস্তিতে ৫ মাসে এক হাজার করে দিব।
রুহুল মিয়া চোখ বন্ধ করে আবার খুলল।
জাকির চেয়ারম্যান। পুলিশ আসবে আর ৩০ মিনিটের মধ্যে। আমি তারে বলে দিব ঐ ৬ জনকে যাতে না খুঁজে।
জাকির চেয়ারম্যান বলল, এই তো মিয়া তুমি হইলা আমাদের ভাইয়ের মত।
রুহুল মিয়া বলল, পুলিশকে আমি ঐ ৬ জনের জন্য আসতে বলিনাই। পুলিশ এসে আমাকে ধরবে।
জাকির চেয়ারম্যান রুহুল মিয়ার দিকে তাকাল। রুহুলের চোখ পুরা লাল বর্ন।
রুহুল মিয়া বলল, এই যে কোদালখানি দেখতেস? এটা দিয়া ৬ জনের কল্লা আলাদা করসি। ৪ জন এক সাথেই ছিল। রহমতের ভাইরে খালি বাজারের পিছনের ক্ষেতে নিয়ে গেসিলাম।
সবাই উৎকন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি কয়!!
জাকির চেয়ারম্যান। আমার মেয়ে নাই। আমার মেয়ে বিত্তি পরীক্ষা দিতে চাইসিল। আমার মেয়ে কুয়ায় ঝাপ দিসে কালকে রাতে। আমি কোদালটা হাতে নিসি। আর নামাইনাই।
হটাৎ গ্রামে হৈ চৈ শুরু হল। ঝিলের ধারে, ক্ষেতে সহ ৬ জনকে পাওয়া গেসে। লাশ অবস্থায়।
জাকির চেয়ারম্যান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। রুহুল মিয়ার দিকে সবাই তাকিয়ে কিন্তু কেউ এগুতে সাহস পাচ্ছেনা। হাতের কোদালটার কারনে। এই কোদাল ৬ জনের জান নিয়েছে।
জাকির চেয়ারম্যান রুহুলের শার্টের কলার ধরল। রুহুল মিয়া বলে, চেয়ারম্যান। কোদালটা এখনও নামাইনাই। তোরে মারা বাকি আসে। সবাই কিছু বুঝার আগেই রুহুল এলোপাথারি ভাবে ৪-৫ টা কোপ দিল। জাকির চেয়ারম্যান গোঙ্গাতে লাগল।
রুহুল মিয়া তার নিজের মেয়ের মৃত্যুতে কাঁদেনায় কথাটা সত্যিনা। কেঁদেছিল পুলিশ আসার পরে। পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত রুহুল মিয়া কোদাল হাতে জাকির চেয়ারম্যানের নিথর দেহের সামনেই পড়ে ছিল। এক ফোটাও নড়েনি। গ্রামের সবাই তাকিয়ে দেখেছে কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। রুহুল মিয়ার পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে সে জাকির মিয়ার মেয়েকেও মারতে চেয়েছিল। কিন্তু অপরাধ যে করেনি তাকে আর মারা হয়নি। কোদাল চালানোর সময় তার মনে হয় ঐ মেয়ের চোখ তার নিজের মেয়ের চোখের মতই।
রুহুল মিয়ার ফাসি হয়নি। ২০ বছর জেলে থাকার পর সে ছাড়া পায়। সে জানি জেল থেকে মুক্তি পায় সে ব্যাবস্থা করার পেছনে নাকি জাকির চেয়ারম্যানের মেয়ের হাত ছিল। বাবা আর ভাই খারাপ হলেই যে মেয়ে খারাপ হবে ব্যাপারটা সব সময় এমন হয়না।
http://www.facebook.com/note.php?note_id=490995403359
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)