WRITTEN BY - AZHAR
বরাবর
মাননীয় মাথামণ্ডলী,
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ,
জনাব,
সবিনয়ে বিনীত নিবেদন এই যে আমি আপনাদের দ্বারা পরিচালিত এই বঙ্গদেশের একজন অতি নগন্য নাগরিক। যদিও আমি নিতান্তই নগন্য, তথাপি আজ আমি আপনাদের কর্মকলাপ সম্পর্কে কিছু কমেন্টস করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি।
বিরোধীদল সংসদে ফেরার পর, আমরা আশা করেছিলাম(এবং প্রতিবারেই যে আশা করে থাকি) যে আপনারা,সরকারি এবং বিরোধীদল,পূর্বের বিভেদ কলহ ভুলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানে সচেষ্ট হবেন। কিন্তু দেখা গেল, যাহাই ’৯৮ এবং ’০৪,’১০ সেপথেই এগুচ্ছে। সংসদে ফিরেই শুরু দুদলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। একজন বলে, আপনার স্বামী ছিল স্বৈরাচারী,তো আরেকজন বলে,আপনার বাবার আমলে তো লোকে না খেয়ে মরসে। একদল বলে আপনাদের সিনিওর মহাসচিব একজন চোর,তো আরেকদল বলে আপনারা তো দূর্নীতি করে সব চোর ডাকাতদের জেল থেকে বের করে দিচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের একটা প্রশ্নের উত্তর দেন ত মাননীয় সাংসদবর্গ, ক্যারেক্টার এভালুয়েশনের জন্য বা স্মৃতিচারন করার জন্য তো আপনাদের আমরা সংসদে বসাইনি। আগে দেশে কি হয়েছে সেটাই যদি আপনাদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে সংসদে না বসে ঘরে বসে স্মৃতিচারণমূলক কোন বই লিখলেই পারেন।
আমাদের গরিব দেশ। আমাদের আয় খুবই সীমিত। সেই সীমিত আয় দিয়েই দেশের সব কার্যক্রম চলে। কোথায় জানি পড়েছিলাম, সংসদে প্রতি মিনিটের কার্যনির্বাহের জন্য প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশের জনগন কি আপনাদের পেছনে মিনিটপ্রতি ১ লাখ টাকা খরচ করছে আপনাদের এইসব আজাইরা পেঁচাল শোনার জন্য? আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পাশে একটা বস্তি ছিল। সেখানে প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে থাকত। তখন তারা,বিশেষ করে মহিলাগুলান একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। আপনাদের ইদানিংকার কথাবার্তা শুনে আমার ঐ বস্তির মহিলাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
সরকার,বিরোধীদল এবং অন্যান্য দলগুলার প্রতি আমার কিছু বলার আছে।
সরকারঃ
১. দেশের বর্তমান আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবস্থা খুব খারাপ। দ্রুত এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন।
২. আপনাদের ছাত্র সংগঠন আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছে। এদের খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রনে আনুন। নইলে পরে এর জন্য আপনাদের পস্তাতে হতে পারে।
৩. আপনাদের কারো কারো মধ্যে একটা প্রবনতা দেখা যায় যে সুযোগ পেলেই তারা বিরোধীদলের সিনিওর মহাসচিব এবং অন্যান্য যারা দূর্নীতি বিষয়ে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাজা খেটেছেন,তাদের নামে উলটাপালটা কথা বলা। তারা অলরেডি তাদের কৃতকর্মের জন্য সাজা খেটে ফেলেছেন। তাদের নিয়ে উলটাপালটা কমেন্টস করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? বিরোধীদল যদি কিছু চিহ্নিত লোকেদের নিজেদের দলে রাখে,সেটা তাদের জন্য নেগেটিভ পয়েন্ট। আপনারা কেন সেধে গায়ে কাদা মাখতে যান?
বিরোধীদলঃ
১. বিরোধীদলের দায়িত্ব সরকারের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করে তাদের সঠিক রাস্তা দেখানো। আপনারা এখন পর্যন্ত আপনাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।
২. চিহ্নিত ব্যক্তিবর্গকে দলে রাখাটাই বড় ভুল। আপনারা আপনাদের চিহ্নিত ব্যক্তিদের বড় পোস্টে বসিয়ে রেখেছেন। জনগনের সমর্থন অর্জনের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করার বোধহয় সময় এসেছে।
ইসলামী সংগঠনসমূহঃ
১. সময়ের সাথে সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো মধ্যযুগে বাস করি না। সভ্যতার সাথে সাথে আপনাদেরও এগুতে হবে। আরো উদারপন্থী হতে হবে।
২. জিহাদ কোন সলুশন না। যারা ইসলামের নিয়মাবলীর ভুল ইন্টারপ্রিটেশন করেন, তাদের বর্জন করুন। ইসলামের পসিটিভ দিকগুলোর প্রতি বেশি জোর দিন।
৩. ছোট ছোট বাচ্চাদের ব্রেইনওয়াশ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের যদি গ্রহনযোগ্যতা থাকে তাহলে অবশ্যই আপনাদের দলে মানুষ যোগ দিবে। দলের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রস্তুত করার অর্থ ভবিষ্যত সম্ভাবনা ধ্বংস করা।
বাংলাদেশ গনতান্ত্রিক দেশ। গনতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা সরকার নির্বাচন করি। সুতরাং আপনাদের চেষ্টা করা উচিত জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর। এত হতাশা, ব্যর্থতার পরও জনগন আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, যে আপনারা এ সমস্যা থেকে উত্তরন করবেন,দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই,এই গরিব মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে, আপনারা এসব কালিমা পেছনে ফেলে দেশকে সামনে এগিয়ে নেবার পদক্ষেপ নিন।
বিনীত,
বাংলাদেশের একজন ক্ষুদ্র নাগরিক।
( আমার বয়স নিতান্তই কম। ছোট মুখে অনেক বড় কথা বলে ফেলেছি। কোন ভুল করে থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।)
DECLARATION
প্রকাশিত লেখা বা মন্তব্য সম্পূর্ণভাবেই লেখক/মন্তব্যকারীর নিজস্ব অভিমত। এর জন্য ashiqurrahman.blogspot.com ব্লগ কর্তৃপক্ষকে কোনভাবেই দায়ী করা চলবেনা।
শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১০
হেকমত আলিদের দিন
WRITTEN BY- SAMEEUR
কদিন ধরেই বাঁ চোখের পাতাটা নাচছে হেকমত আলির। লক্ষণটা নাকি শুভ কিন্তু শুভ ভাবার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না এই অবসর প্রাপ্ত আমলা। সেই পাকিস্তান আমলে সরকারী চাকুরিতে ঢুকেছিলেন, বাংলাদেশ হওয়ার সময় ট্রেনিং এ ছিলেন ইংল্যান্ডে। তারপর স্বাধীন দেশের ফাঁকা পদে এসে ফেঁদে বসেছেন। একে ওকে এটা ওটা বুঝিয়ে নিজের পকেটটা ভরানোর কায়দাটা ভালোই জানতেন। হল জীবনে এই করেই তো কত বন্ধুর ঘাড় ভেঙ্গে খেয়েছেন! এভাবেই একদিন এই মন্ত্রণালয়, ঐ দপ্তর ঘুরে একসময় অবসর। ছেলে মেয়েদের বাইরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, আর ফেরেনি। মাঝে সাঝে একটু ফোন, বাবা ভালো আছো, বুকের ব্যথাটা কমেছে এই ব্যস। বিয়েটা কমবয়সে করেছিলেন, এক ধনী পিতার কন্যাকে পড়াশোনার সাথে সাথে প্রেমের পাঠটাও দিতেন। যদিও নজর ছিলো ওয়ারির বাড়িটার আংশিক মালিকানার দিকে। সেই বৌ ও আজকাল আর সময় দেয় না। বছরের ছমাসই থাকেন দেশের বাইরে, ছেলেমেয়েদের কাছে। অবসর জীবনটা তাই খুব একাই কাটে হেকমত সাহেবের। আর একটা জিনিষের খুব অভাব লাগে তার কাছে, গুণমুগ্ধ শ্রোতার। যখন চাকরিতে ছিলেন তখন আশে পাশে শোনার লোকের অভাব ছিলো না। প্রাইমারি স্কুলের পুরষ্কার বিতরণী থেকে অর্থনৈতিক সমিতির সাধারণ সভা , দাওয়াত পেলে কোথাও না করতেন না। হাত নেড়ে, চোখের ভাষায়, গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে ভালোই বলতে পারতেন তিনি। আর বিলেতের ট্রেনিং এ একটা জিনিষ বুঝেছিলেন, ইংরেজিটা হলো প্রভুর ভাষা। তাই সাধারণ কথাটাই মাঝে মাঝে ইংরেজিতে বলতেন জনাব হেকমত, তাতে হাততালিটা বেশি পাওয়া যেত। আর হলভরা দর্শকের হাততালির আওয়াজ শুনে যে তৃপ্তি, বিশেষ একটা মাত্র ব্যাপারের সঙ্গেই তার তুলনা করা যায়! সেই মুগ্ধ শ্রোতার কাজটাও ঘুচিয়েছিলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। অনিদ্রা রোগে এমনিতেই ঘুম আসে না, আর চ্যানেলগুলোরও ২৪ ঘন্টা অনুষ্ঠান চালানো দরকার। এই দুয়ে মিলে কপাল খুলে গেলো হেকমত সাহেবের। সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা, ভালো বলিয়ে আর কি চাই। সারা দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে সরকারের মুন্ডুপাত আর দেশ ও জাতির চোখ খুলে দেয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন তিনি। তীর্যক মন্তব্য করে সাড়াও ফেলে দিলেন তিনি। আর তার অনুষ্ঠানে কিছু উটকো ফোনে “অনাকাংখিত” কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে তার পরিচিতি আরও বাড়িয়ে দিলো। যদিও ব্যাপারটা একেবারেই “কাংখিত”, কারণ ততদিনে লোকে “কোনটা খায়” এই জিনিষটা ভালোই বুঝেগিয়েছিলেন ঝানু আমলা হেকমত। নিজের লোক দিয়ে ফোন করিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলিয়ে স্পটলাইটটা নিজের উপর নিয়ে আসতে খুব বেশিদিন লাগে নি তার। তাইতো টিভি চ্যানেলগুলোতে ব্যস্ত মডেল বা তারকা সংবাদ পাঠিকাদের মতো তার টেকো মাথা চেহারাটাও চোখে পড়ে। কিন্তু কদিন ধরেই একটু মনমরা হয়ে ছিলেন তিনি, কারণ আর কিছুই না “বিষয়ের” অভাব।
“লোডশেডিং” হয়েছে, “দ্রবমূল্য”র আর আগের মতো মার্কেট ভ্যালু নেই, পাশা পাল্টে যাওয়ায় যথেচ্ছা সরকারের বিষেদগারও করা যাচ্ছে না। তাই কথাবার্তা গুলো আর আগের মতো জমছে না। সাহিত্যের সঙ্গে হেকমত সাহেবের সম্পর্কটা আদায় কাঁচকলায় না হলেও কাছাকাছি। তাই পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী, কিংবা নিদেন পক্ষে মে দিবসের অনুষ্ঠানেও ডাক পড়েনি তার। আশা করেছিলেন সামনে বাজেট আসছে, ব্যস্ততা বাড়বে। তা আর হলো কই? কোথাকার কোন মুসা না ইসা, সে নাকি হিমালয় পাহাড়ের চূড়া থেকে ঘুরে এসেছে! আরে বাবা যৌবনে জরিপের কাজে রাঙ্গামাটি বান্দরবনের পাহাড়ে কম ঘুরেছেন নাকি। সরকারী ডাকবাংলোতে থাকা, সেখানকার বাবুর্চির রান্না…তোফা তোফা। হিমালয়টাও নিশ্চয়ই ওরকম, আরেকটু উঁচু এই যা। ওখানেও নাকি ঘাটে ঘাটে বেস ক্যাম্প আছে, ফোন করা যায় তাহলে আর চিন্তা কি। ঠান্ডাটা একটু বেশি আর খাড়া তাই দড়ি দড়া নিয়ে উঠতে হয়। নেহাত বয়েস হয়ে গেছে আর পুরনো বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। নইলে অমন একটা পাহাড়ে চড়াটা কোন ব্যাপার হলো। শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে ছাপা হওয়া মুসার হাসিমুখের ছবিটা দেখে এটাই ভাবছিলেন হেকমত সাহেব। এই কদিন আলোচনার টেবিলে মুসাই থাকবে, যত্তসব। একটা ছেলে পাহাড়ে উঠেছে বলে কি মাথা কিনে ফেলেছে নাকি? দেশের এই অস্থিরতা, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত সংঘাত, যানজট এসব নিয়ে আলোচনা না করলে দেশ এগোবে কিভাবে? রমিজ কে ডেকে চা দিতে বলে এসব ভাবতে ভাবতেই মনে মনে গজরাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় চালু হিন্দি গানের রিংটোনে বেজে উঠলো তার কদিন আগেই কেনা দামী মোবাইল খানা। স্ক্রিনে নাম দেখলেন, শরিফ সদরুল। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। টক শো গুলোতে মাঝে মাঝেই তাদের একসঙ্গে দেখা যায়। পর্দায় তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক আর মতবিরোধ হলেও বাইরে তাদের ভালোই মিল। হেকমত সাহেবও বুঝে গিয়েছেন, তাদের জুটিটা পাবলিক “খায়”।
কি হেকমত সাহেব, খোঁজ খবর রাখছেন কিছু? ২২ জন তো শেষ…
আরে ছাড়ুনতো এসব, হয়েছে টা কি? এদেশে এত্তো মানুষে মানুষে গিজগিজ…
আরে “চোখ” টিভিতে দেখুন, ওরা লাইভ দেখাচ্ছে…
আচ্ছা দেখছি।
হেকমত সাহেব রিমোট খুঁজে তার ৪২ ইঞ্চি প্লাজমা টিভিটা ছাড়লেন। টিভিতে টকশো করে পাওয়া টাকাতেই ভালো করে টিভি দেখার ব্যবস্থা, কই এর তেলে কই ভাজা আরকি। রিমোট টিপে চোখ টিভিতে গেলেন। চ্যানেলটা ভালো, প্রডিউসার ছেলেটা খাতির করে, গেলে ভালো নাস্তা টাস্তা আনিয়ে খাওয়ায়। একদিন কথায় কথা পুর্বানীর কেক এর কথা বলেছিলেন, এরপর স্টুডিওতে গেলেই বের হওয়ার পর তার জন্য পুর্বানীর কেক থাকে।
রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে একটু বহুতল ভবন কাত হয়ে পরে গেলে…… ক্যামেরায় রিপোর্টারকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু কন্ঠটা শোনা যাচ্ছে। আর ৪২ ইঞ্চি ঝকঝকে পর্দা জুড়ে শোকাহত মানুষের মাতম, কান্না, স্বজনহারানোর যন্ত্রণা। “পাশের টিনের বস্তির বেশিরভাগ মানুষ তখন ঘুমিয়ে ছিলেন…” আবারও বলছে রিপোর্টার মেয়েটা। আরে মেয়েটা দেখতে সুন্দর আছে তো, একে রিপোর্টিং এ না দিয়ে টকশো উপস্থাপনাতে দেয় না কেন?…রাজউকের উদাসীনতা, বিল্ডিং কোড না মানা, অনুমোদনহীন ভবন নির্মান…মেয়েটা বলেই যাচ্ছে দেখি। এবার বাচ্চাকোলে এক ভুক্তভোগী মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, “ আমার চাইর বছরের মাইয়াটা… বিকট একটা শব্দ শুইনা কোলের পোলাটা লইয়া দৌড় পাইরা বাইর হইসি, মাইয়াটারে ডাকবারও পারি নাই। কাইলকা বাচ্চাডারে জামা কিন্যা দিমু কইসিলাম…আল্লাগো…
নাহ, বয়সে কিছুটা ছোট অধ্যাপকের উপর খানিকটা বিরক্তই হন হেকমত সাহেব। লেখাপড়া আর আইন জানলে কি হবে “নিউজ সেন্স”টাই এখনো তৈরি হয়নি। দূর্যোগ মন্ত্রী যায়নি, গণপূর্ত মন্ত্রী যায়নি এমনকি ডিএমপি কমিশনারকেও দেখা যায়নি। বিশ্বকাপের বাজারে এই নিউজ সেনসেসনালাইজ হবে না। হুঁ বাবা, বিশ্বকাপ বলে কথা। বাংলাদেশ খেলুক আর নাই খেলুক পতাকা ওড়ানো চাই, রাত জেগে খেলা দেখা চাই। আরে আছেটা কি হাফপ্যান্ট পড়া ঐ লোকগুলোর বলের পেছনে ছোটাছুটির মধ্যে! মাঝে আইপিএলটা অবশ্য বেশ ভালোই মজা নিয়ে দেখেছিলেন। গ্যালারিতে বলিউডের নায়িকারা ছিলো, চার ছক্কা হলে বেশ দারুণ নাচ ছিলো, সন্ধ্যেটা ভালোই কেটে যেতো। এই আইপিএল নিয়ে ভারতে কত সুন্দর টকশো হচ্ছিলো। ৩ ঘন্টার খেলার আগে, পরে ও মাঝে মিলিয়ে ৬ ঘন্টার টকশো। বাংলাদেশেও কি এমন করা যেতো না। কথায় কথায় সিনেমা, গানে, বিজ্ঞাপণে প্রতিবেশী দেশের উদাহারণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে টকশো আসলে ক্ষতিটা কোথায়?
ক্রিকেটটা তাও অবসর জীবনে খানিকটা সময় কাটানোর সঙ্গী ছিলো বলে ব্যাটিং আর বোলিং এর তফাতটা বোঝেন। তাছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু খেলে, বেশ কিছু উপলক্ষ্যে তাকে এ ব্যাপারে একটু বলতেও হয়েছে। সাংবাদিকগুলো যা হয়েছে না, কোন একটা ম্যাচ জিতলেই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছেপে দেয়। একটু আধটু ক্রিকেট না জানলে সংবাদপত্র পর্যালোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে তো ঝামেলাতেই পড়তে হতো। কিন্তু ফুটবল একদম নয়! সেই কবে ম্যারাডোনার খেলা দেখেছিলেন, তাই আর্জেন্টিনার নামটা জানেন। আর কফির সুবাদে ব্রাজিলের নামটা শুনেছেন। কিন্তু এরা কে এখন কেমন খেলে, কারা খেলছে এই নিয়ে একদমই হদিশ রাখেন না তিনি। তাই বিশ্বকাপের সময় যে ফুটবল নিয়ে গলাবাজী করে কিছুটা চেহারা দেখাবেন এই সুযোগটাও হচ্ছে না। আর মানুষ খেলার কথা শুনতে চায় খেলোয়াড়ের কাছ থেকে, কিন্তু হেকমত সাহেবের তো “ফাইল টেবিল” খেলা ছাড়া আর কোন খেলাই যে খেলেননি। তাই ভাবছিলেন এই জৈষ্ঠমাসে দেশের বাড়িতে গিয়ে একটু আম কাঠাল খেয়ে আসবেন। দেশেও একটা বাগান বাড়ী মতো বানিয়েছেন তিনি, এক গ্রাম সম্পর্কের ভাস্তে আছে, সেই দেখে। ফলটা মূলটা দেয়, গেলে খাতির তোয়াজ করে আর কি চাই।
কদিন ঘরেই তাই দেশে যাবার কথা ভাবছিলেন তিনি, কিন্তু বৃহস্পতিবারের রাত পালটে দিলো সব। নিমতলীর রুনার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সবার গায়ে ছড়িয়ে গেলো হলুদ আগুন। মানুষ আবারো দেখলো নিজেদের অসহায়ত্ব, ২০০ গজ দুরের ফায়ার স্টেসনের গাড়ি এলো দেরীতে, পানির উৎস খুঁজে পেতে নষ্ট হলো আরো কিছু সময়, এরমধ্যেই হয়তো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে আদৃতা। কিন্তু এই আঁচ অভিজাত এলাকায় বাস করা হেকমত আলীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের ভেতরে পৌঁছায়নি। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের তার বেয়ে পৌঁছেছে শুধুই “সংবাদ”। ঝকঝকে টিভি পর্দায় আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে থাকা হেকমত আলীর চোখটা কেমন যেন চকচক করে ওঠে। পরপর দুই দিন দুইটা “স্টোরি”। রাজউক, পিডিবি, ডেসকো সহ অনেকের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধারের এখনই সময়। টক শো তে কিসের মুসা, কিসের বিশ্বকাপ? দিন আবারো আসছে…প্রযোজকের ফোন, চ্যানেলের গাড়ী, খামের ভেতর চেক… আচ্ছা বেগুনবাড়ীর ঘটনার রিপোর্টার মেয়েটা যেন কোন চ্যানেলের ছিলো? চোখ টিভির না বাইশে টেলিভিশনের…নাহ…একদম মনে পড়ছে না…
( কোনকিছু কারো সাথে মিলে গেলে তা নিতান্ত কাকতাল মাত্র। সবই মূর্খ ব্লগারের অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র)
কদিন ধরেই বাঁ চোখের পাতাটা নাচছে হেকমত আলির। লক্ষণটা নাকি শুভ কিন্তু শুভ ভাবার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না এই অবসর প্রাপ্ত আমলা। সেই পাকিস্তান আমলে সরকারী চাকুরিতে ঢুকেছিলেন, বাংলাদেশ হওয়ার সময় ট্রেনিং এ ছিলেন ইংল্যান্ডে। তারপর স্বাধীন দেশের ফাঁকা পদে এসে ফেঁদে বসেছেন। একে ওকে এটা ওটা বুঝিয়ে নিজের পকেটটা ভরানোর কায়দাটা ভালোই জানতেন। হল জীবনে এই করেই তো কত বন্ধুর ঘাড় ভেঙ্গে খেয়েছেন! এভাবেই একদিন এই মন্ত্রণালয়, ঐ দপ্তর ঘুরে একসময় অবসর। ছেলে মেয়েদের বাইরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, আর ফেরেনি। মাঝে সাঝে একটু ফোন, বাবা ভালো আছো, বুকের ব্যথাটা কমেছে এই ব্যস। বিয়েটা কমবয়সে করেছিলেন, এক ধনী পিতার কন্যাকে পড়াশোনার সাথে সাথে প্রেমের পাঠটাও দিতেন। যদিও নজর ছিলো ওয়ারির বাড়িটার আংশিক মালিকানার দিকে। সেই বৌ ও আজকাল আর সময় দেয় না। বছরের ছমাসই থাকেন দেশের বাইরে, ছেলেমেয়েদের কাছে। অবসর জীবনটা তাই খুব একাই কাটে হেকমত সাহেবের। আর একটা জিনিষের খুব অভাব লাগে তার কাছে, গুণমুগ্ধ শ্রোতার। যখন চাকরিতে ছিলেন তখন আশে পাশে শোনার লোকের অভাব ছিলো না। প্রাইমারি স্কুলের পুরষ্কার বিতরণী থেকে অর্থনৈতিক সমিতির সাধারণ সভা , দাওয়াত পেলে কোথাও না করতেন না। হাত নেড়ে, চোখের ভাষায়, গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে ভালোই বলতে পারতেন তিনি। আর বিলেতের ট্রেনিং এ একটা জিনিষ বুঝেছিলেন, ইংরেজিটা হলো প্রভুর ভাষা। তাই সাধারণ কথাটাই মাঝে মাঝে ইংরেজিতে বলতেন জনাব হেকমত, তাতে হাততালিটা বেশি পাওয়া যেত। আর হলভরা দর্শকের হাততালির আওয়াজ শুনে যে তৃপ্তি, বিশেষ একটা মাত্র ব্যাপারের সঙ্গেই তার তুলনা করা যায়! সেই মুগ্ধ শ্রোতার কাজটাও ঘুচিয়েছিলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। অনিদ্রা রোগে এমনিতেই ঘুম আসে না, আর চ্যানেলগুলোরও ২৪ ঘন্টা অনুষ্ঠান চালানো দরকার। এই দুয়ে মিলে কপাল খুলে গেলো হেকমত সাহেবের। সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা, ভালো বলিয়ে আর কি চাই। সারা দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে সরকারের মুন্ডুপাত আর দেশ ও জাতির চোখ খুলে দেয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন তিনি। তীর্যক মন্তব্য করে সাড়াও ফেলে দিলেন তিনি। আর তার অনুষ্ঠানে কিছু উটকো ফোনে “অনাকাংখিত” কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে তার পরিচিতি আরও বাড়িয়ে দিলো। যদিও ব্যাপারটা একেবারেই “কাংখিত”, কারণ ততদিনে লোকে “কোনটা খায়” এই জিনিষটা ভালোই বুঝেগিয়েছিলেন ঝানু আমলা হেকমত। নিজের লোক দিয়ে ফোন করিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলিয়ে স্পটলাইটটা নিজের উপর নিয়ে আসতে খুব বেশিদিন লাগে নি তার। তাইতো টিভি চ্যানেলগুলোতে ব্যস্ত মডেল বা তারকা সংবাদ পাঠিকাদের মতো তার টেকো মাথা চেহারাটাও চোখে পড়ে। কিন্তু কদিন ধরেই একটু মনমরা হয়ে ছিলেন তিনি, কারণ আর কিছুই না “বিষয়ের” অভাব।
“লোডশেডিং” হয়েছে, “দ্রবমূল্য”র আর আগের মতো মার্কেট ভ্যালু নেই, পাশা পাল্টে যাওয়ায় যথেচ্ছা সরকারের বিষেদগারও করা যাচ্ছে না। তাই কথাবার্তা গুলো আর আগের মতো জমছে না। সাহিত্যের সঙ্গে হেকমত সাহেবের সম্পর্কটা আদায় কাঁচকলায় না হলেও কাছাকাছি। তাই পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী, কিংবা নিদেন পক্ষে মে দিবসের অনুষ্ঠানেও ডাক পড়েনি তার। আশা করেছিলেন সামনে বাজেট আসছে, ব্যস্ততা বাড়বে। তা আর হলো কই? কোথাকার কোন মুসা না ইসা, সে নাকি হিমালয় পাহাড়ের চূড়া থেকে ঘুরে এসেছে! আরে বাবা যৌবনে জরিপের কাজে রাঙ্গামাটি বান্দরবনের পাহাড়ে কম ঘুরেছেন নাকি। সরকারী ডাকবাংলোতে থাকা, সেখানকার বাবুর্চির রান্না…তোফা তোফা। হিমালয়টাও নিশ্চয়ই ওরকম, আরেকটু উঁচু এই যা। ওখানেও নাকি ঘাটে ঘাটে বেস ক্যাম্প আছে, ফোন করা যায় তাহলে আর চিন্তা কি। ঠান্ডাটা একটু বেশি আর খাড়া তাই দড়ি দড়া নিয়ে উঠতে হয়। নেহাত বয়েস হয়ে গেছে আর পুরনো বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। নইলে অমন একটা পাহাড়ে চড়াটা কোন ব্যাপার হলো। শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে ছাপা হওয়া মুসার হাসিমুখের ছবিটা দেখে এটাই ভাবছিলেন হেকমত সাহেব। এই কদিন আলোচনার টেবিলে মুসাই থাকবে, যত্তসব। একটা ছেলে পাহাড়ে উঠেছে বলে কি মাথা কিনে ফেলেছে নাকি? দেশের এই অস্থিরতা, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত সংঘাত, যানজট এসব নিয়ে আলোচনা না করলে দেশ এগোবে কিভাবে? রমিজ কে ডেকে চা দিতে বলে এসব ভাবতে ভাবতেই মনে মনে গজরাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় চালু হিন্দি গানের রিংটোনে বেজে উঠলো তার কদিন আগেই কেনা দামী মোবাইল খানা। স্ক্রিনে নাম দেখলেন, শরিফ সদরুল। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। টক শো গুলোতে মাঝে মাঝেই তাদের একসঙ্গে দেখা যায়। পর্দায় তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক আর মতবিরোধ হলেও বাইরে তাদের ভালোই মিল। হেকমত সাহেবও বুঝে গিয়েছেন, তাদের জুটিটা পাবলিক “খায়”।
কি হেকমত সাহেব, খোঁজ খবর রাখছেন কিছু? ২২ জন তো শেষ…
আরে ছাড়ুনতো এসব, হয়েছে টা কি? এদেশে এত্তো মানুষে মানুষে গিজগিজ…
আরে “চোখ” টিভিতে দেখুন, ওরা লাইভ দেখাচ্ছে…
আচ্ছা দেখছি।
হেকমত সাহেব রিমোট খুঁজে তার ৪২ ইঞ্চি প্লাজমা টিভিটা ছাড়লেন। টিভিতে টকশো করে পাওয়া টাকাতেই ভালো করে টিভি দেখার ব্যবস্থা, কই এর তেলে কই ভাজা আরকি। রিমোট টিপে চোখ টিভিতে গেলেন। চ্যানেলটা ভালো, প্রডিউসার ছেলেটা খাতির করে, গেলে ভালো নাস্তা টাস্তা আনিয়ে খাওয়ায়। একদিন কথায় কথা পুর্বানীর কেক এর কথা বলেছিলেন, এরপর স্টুডিওতে গেলেই বের হওয়ার পর তার জন্য পুর্বানীর কেক থাকে।
রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে একটু বহুতল ভবন কাত হয়ে পরে গেলে…… ক্যামেরায় রিপোর্টারকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু কন্ঠটা শোনা যাচ্ছে। আর ৪২ ইঞ্চি ঝকঝকে পর্দা জুড়ে শোকাহত মানুষের মাতম, কান্না, স্বজনহারানোর যন্ত্রণা। “পাশের টিনের বস্তির বেশিরভাগ মানুষ তখন ঘুমিয়ে ছিলেন…” আবারও বলছে রিপোর্টার মেয়েটা। আরে মেয়েটা দেখতে সুন্দর আছে তো, একে রিপোর্টিং এ না দিয়ে টকশো উপস্থাপনাতে দেয় না কেন?…রাজউকের উদাসীনতা, বিল্ডিং কোড না মানা, অনুমোদনহীন ভবন নির্মান…মেয়েটা বলেই যাচ্ছে দেখি। এবার বাচ্চাকোলে এক ভুক্তভোগী মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, “ আমার চাইর বছরের মাইয়াটা… বিকট একটা শব্দ শুইনা কোলের পোলাটা লইয়া দৌড় পাইরা বাইর হইসি, মাইয়াটারে ডাকবারও পারি নাই। কাইলকা বাচ্চাডারে জামা কিন্যা দিমু কইসিলাম…আল্লাগো…
নাহ, বয়সে কিছুটা ছোট অধ্যাপকের উপর খানিকটা বিরক্তই হন হেকমত সাহেব। লেখাপড়া আর আইন জানলে কি হবে “নিউজ সেন্স”টাই এখনো তৈরি হয়নি। দূর্যোগ মন্ত্রী যায়নি, গণপূর্ত মন্ত্রী যায়নি এমনকি ডিএমপি কমিশনারকেও দেখা যায়নি। বিশ্বকাপের বাজারে এই নিউজ সেনসেসনালাইজ হবে না। হুঁ বাবা, বিশ্বকাপ বলে কথা। বাংলাদেশ খেলুক আর নাই খেলুক পতাকা ওড়ানো চাই, রাত জেগে খেলা দেখা চাই। আরে আছেটা কি হাফপ্যান্ট পড়া ঐ লোকগুলোর বলের পেছনে ছোটাছুটির মধ্যে! মাঝে আইপিএলটা অবশ্য বেশ ভালোই মজা নিয়ে দেখেছিলেন। গ্যালারিতে বলিউডের নায়িকারা ছিলো, চার ছক্কা হলে বেশ দারুণ নাচ ছিলো, সন্ধ্যেটা ভালোই কেটে যেতো। এই আইপিএল নিয়ে ভারতে কত সুন্দর টকশো হচ্ছিলো। ৩ ঘন্টার খেলার আগে, পরে ও মাঝে মিলিয়ে ৬ ঘন্টার টকশো। বাংলাদেশেও কি এমন করা যেতো না। কথায় কথায় সিনেমা, গানে, বিজ্ঞাপণে প্রতিবেশী দেশের উদাহারণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে টকশো আসলে ক্ষতিটা কোথায়?
ক্রিকেটটা তাও অবসর জীবনে খানিকটা সময় কাটানোর সঙ্গী ছিলো বলে ব্যাটিং আর বোলিং এর তফাতটা বোঝেন। তাছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু খেলে, বেশ কিছু উপলক্ষ্যে তাকে এ ব্যাপারে একটু বলতেও হয়েছে। সাংবাদিকগুলো যা হয়েছে না, কোন একটা ম্যাচ জিতলেই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছেপে দেয়। একটু আধটু ক্রিকেট না জানলে সংবাদপত্র পর্যালোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে তো ঝামেলাতেই পড়তে হতো। কিন্তু ফুটবল একদম নয়! সেই কবে ম্যারাডোনার খেলা দেখেছিলেন, তাই আর্জেন্টিনার নামটা জানেন। আর কফির সুবাদে ব্রাজিলের নামটা শুনেছেন। কিন্তু এরা কে এখন কেমন খেলে, কারা খেলছে এই নিয়ে একদমই হদিশ রাখেন না তিনি। তাই বিশ্বকাপের সময় যে ফুটবল নিয়ে গলাবাজী করে কিছুটা চেহারা দেখাবেন এই সুযোগটাও হচ্ছে না। আর মানুষ খেলার কথা শুনতে চায় খেলোয়াড়ের কাছ থেকে, কিন্তু হেকমত সাহেবের তো “ফাইল টেবিল” খেলা ছাড়া আর কোন খেলাই যে খেলেননি। তাই ভাবছিলেন এই জৈষ্ঠমাসে দেশের বাড়িতে গিয়ে একটু আম কাঠাল খেয়ে আসবেন। দেশেও একটা বাগান বাড়ী মতো বানিয়েছেন তিনি, এক গ্রাম সম্পর্কের ভাস্তে আছে, সেই দেখে। ফলটা মূলটা দেয়, গেলে খাতির তোয়াজ করে আর কি চাই।
কদিন ঘরেই তাই দেশে যাবার কথা ভাবছিলেন তিনি, কিন্তু বৃহস্পতিবারের রাত পালটে দিলো সব। নিমতলীর রুনার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সবার গায়ে ছড়িয়ে গেলো হলুদ আগুন। মানুষ আবারো দেখলো নিজেদের অসহায়ত্ব, ২০০ গজ দুরের ফায়ার স্টেসনের গাড়ি এলো দেরীতে, পানির উৎস খুঁজে পেতে নষ্ট হলো আরো কিছু সময়, এরমধ্যেই হয়তো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে আদৃতা। কিন্তু এই আঁচ অভিজাত এলাকায় বাস করা হেকমত আলীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের ভেতরে পৌঁছায়নি। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের তার বেয়ে পৌঁছেছে শুধুই “সংবাদ”। ঝকঝকে টিভি পর্দায় আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে থাকা হেকমত আলীর চোখটা কেমন যেন চকচক করে ওঠে। পরপর দুই দিন দুইটা “স্টোরি”। রাজউক, পিডিবি, ডেসকো সহ অনেকের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধারের এখনই সময়। টক শো তে কিসের মুসা, কিসের বিশ্বকাপ? দিন আবারো আসছে…প্রযোজকের ফোন, চ্যানেলের গাড়ী, খামের ভেতর চেক… আচ্ছা বেগুনবাড়ীর ঘটনার রিপোর্টার মেয়েটা যেন কোন চ্যানেলের ছিলো? চোখ টিভির না বাইশে টেলিভিশনের…নাহ…একদম মনে পড়ছে না…
( কোনকিছু কারো সাথে মিলে গেলে তা নিতান্ত কাকতাল মাত্র। সবই মূর্খ ব্লগারের অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র)
স্বজাতি কুকুর ও সেই সব যুদ্ধবন্দী
WRITTEN BY- SHAWKOT
‘একাত্তরের সংকটের জন্য কিছু লোক সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে, আবার কেউ কেউ দায়ী করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে যে আমরা সঠিক ছিলাম। গোলাম আজম সাহেবসহ সাধারণ মানুষ এখনো মনে করেন না আমরা ভুল করেছি।’
১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদে জেনারেল টিক্কা খানের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মুসা সাদিক। মুসা সাদিক মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধ সংবাদদাতা ছিলেন। আর এই সাক্ষাৎকারটি পেলাম তাঁর বই ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’-এ।
এটুকু পড়তে পড়তেই মনে পড়ে গেল যতীন সরকারের ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বইটির কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রুকন উদ্দিন মুন্সী নামের এক ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গের কথোপকথন তিনি তুলে দিয়েছিলেন।
‘……কুকুর মানুষের এতো উপকার করে, তবু কুকুরের ছোঁয়া লাগলে অজু নষ্ট হয়ে যায় কেন বলতে পারেন?’
‘তা আমি কি করে বলবো? এর জবাব তো আপনিই ভাল জানেন’।
‘তা হলে শুনুন। কুকুর মানুষের উপকার করে ঠিকই, কিন্তু তার স্বজাতিকে সে দু’চোখে দেখতে পারে না। পরজাতি মানুষের জন্য কুকুর জান দেয়, কিন্তু স্বজাতির কাউকে দেখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কামড়াকামড়ি করে। কুকুর তার স্বজাতিকে অর্থাৎ অন্য কুকুরকে ভালবাসে-এরকম আপনি কোখাও দেখতে পাবেন না। স্বজাতিকে এমন হিংসা করে বলেই কুকুর প্রাণীটা একেবারে না-পাক।’
একটু থেমে আবার সেই মহাকুমা শহরের শান্তি কমিটির চাঁইদের কথা তুললেন রুকন উদ্দিন মুন্সী। বললেন,‘ওরাও ওই কুকুরের মতো। ওরা পরজাতি পাকিস্তানিদের জন্যে জান কোরবান করতে নেমেছে স্বজাতি বাঙালিদের সর্বনাশ করে। ওরাও না-পাক। যতো বড়ো আলেমই হোক এরা, এদের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লে তা কবুল হবে না কিছুতেই।’
এই কুকুরগুলোর কর্মকান্ড কমবেশি সকলেরই জানা। এ নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে। পাকিস্তানিরাও কিন্তু অল্প হলেও কিছু লিখেছেন। এরকম একটি বই হচ্ছে সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার।’ সিদ্দিক সালিক ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে টিক্কা খান ও পরে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি লিখেছেন, ‘…..‘দেশপ্রেমিক’ পাকিস্তানিদের খবরের ওপর ভিত্তি করে তারা প্রায়শই ‘সন্ধান উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ চালাতে লাগলো। খবর সরবরাহকারীদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানের সংহতির ব্যাপারে সত্যিকার অর্থেই আগ্রহী ছিল এবং সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য জীবনের ঝুঁকিও নিত। কিছু অবশ্য আওয়ামী লীগপন্থীদের নিজেদের পুরানো ক্ষত মীমাংশার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে নিজেদের যোগাযোগকে ব্যবহার করতো। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একদিন একজন দক্ষিনপন্থী রাজনীতিক একটি তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক আইন সদর দফতরে আসে। বারান্দাতে হঠাৎ করেই তার সাথে আমার দেখা। আস্থাভরে ফিসফিসিয়ে সে বললো, ‘বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর তার কাছে আছে।’ আমি তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে সে বললো, ‘বালকটি তার ভাইয়ের ছেলে। সে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পার কেরানীগঞ্জের বিদ্রোহীদের বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে।’ বালকটি আরো বললো, ‘বিদ্রোহীরা শুধু স্থানীয় লোকজনদের হয়রানিই করছে না-রাতে শহর আক্রমনের পরিকল্পনা নিয়েছে।’
তৎক্ষনাৎ উচ্ছেদকরণ অপারেশনের আদেশ দেওয়া হয়। আক্রমণকারী সৈন্যদের কমান্ডারকে ব্রিফ করা হলো। ভোর হবার আগেই ল্যকে নমনীয় করার উদ্দেশ্যে গোলাবর্ষনের জন্য ফিল্ডগান, মর্টার ও রিকয়েললেস রাইফেলস প্রস্তুত করা হলো। স্থানটি সকাল হবার আগেই দখল করবার জন্যে সৈন্যরা সাঁড়াশি অভিযান চালাবে।
যে অফিসার হামলা পরিচালনা করে, সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করলাম। সে যা বললো, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘ওখানে কোনো বিদ্রোহী ছিল না। ছিল না অস্ত্রও। শুধু গ্রামের গরিব লোকেরা-অধিকাংশ নারী এবং বৃদ্ধ। গোলার আগুনের মাঝে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, গোয়েন্দা মারফত সঠিক সংবাদ সংগ্রহ না করেই এই হামলা পরিচালিত হয়েছে। আমার বিবেকের ওপর এ ভার আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াবো।’
তারপরেও দেশ স্বাধীন হল। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরলেন দেশে। দেশ চালানোর ভার নিলেন। ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭২।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারি প্রেসনোটের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা জানানো হয়। একইসঙ্গে দালাল আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। (১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বরের আগে পর্যন্ত দালাল আইনের মামলাগুলোয় ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে এদের ২৬ হাজার ছাড়া পেয়ে যায়। আর ১১ হাজার দালাল বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ভোগ করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএসএম সায়েম ও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার পুরোপুরি দালাল আইন বাতিল করার পর ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই আপিল করে এরা সব ছাড়া পেয়ে যায়। ছাড়া পাওয়া দালালদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার আসামিরাও ছিল।)
প্রশ্ন হচ্ছে কেন বঙ্গবন্ধু এতখানি নমনীয় হয়েছিলেন দালালদের প্রতি। কেনই বা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীদের বিচার করতে পারলেন না।
‘ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গেলাম গণভবণে। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খান আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর অফিস কক্ষে। কয়েকজন মন্ত্রী তখন সেখানে উপস্থিত। তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিলেন। বললেন, এখনি একটা সরকারি ঘোষণার খসড়া তোমাকে লিখতে হবে। পাকিস্তানীদের মধ্যে কোলাবরেটর হিসেবে যারা দন্ডিত ও অভিযুক্ত হয়েছেন, সকলের জন্যও ঢালাও ক্ষমা (জেনারেল এ্যামনেষ্টি) ঘোষণা করতে যাচ্ছি।
বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, পালের গোদাদেরও ছেড়ে দেবেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। সকলকে। কেবল যাদের বিরুদ্ধে খুন, রাহাজানি, ঘরে আগুন দেয়া, নারী-হরণ বা ধর্ষণ প্রভৃতির অভিযোগ রয়েছে, তারা ছাড়া পাবেন না। কেন, ঢালাও ক্ষমা ঘোষণায় তোমার মত নেই?
বললাম, না, নেই। পাকিস্তানীদের অত্যাচারে সাহায্য যোগানের অভিযোগে যে হাজার হাজার লোক বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের প্রতি আপনি ক্ষমা প্রদর্শন করুন। আপত্তি নেই। তাদের অনেকেই নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য জোগাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পালের গোদাদের আপনি ক্ষমা করবেন না। এরা বাংলাদেশের শত্রু। এদের বিচার ও দন্ড হওয়া দরকার।
মুজিব হেসে বললেন, না তা হয় না। সকলকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমার এ আসনে বসলে তোমাকেও তাই করতে হত। আমিতো চেয়েছিলাম নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে অন্তত ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধী অফিসারের বিচার করতে। তাও পেরেছি কী? আমি একটা ছোট্ট অনুন্নত দেশের নেতা। চারিদিকে উন্নত ও বড় শক্তির চাপ। ইচ্ছা থাকলেই কি আর সব কাজ করা যায়?’ (ইতিহাসের রক্তপলাশ: পনের আগস্ট পঁচাত্তর, আবদুল গাফফার চৌধুরী।)
আসলে কি হচ্ছিল তখন?
১৫ এপ্রিল, ১৯৭২। মার্কিণ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি গোপন চিঠি লেখেন ভুট্টো। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘ভারতীয় মদদে শেখ মুজিবুর রহমান এক হাজার ৫০০ যুদ্ধবন্দীর ‘যুদ্ধাপরাধের’ জন্য বিচারের ব্যাপারে বন্ধপরিকর বলে মনে হয়। যদি বাংলাদেশ সত্যি সত্যি তেমন পথে এগোয়, তাহলে তার মারাত্বক প্রতিক্রিয়া হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানে লাখ খানেক বাঙালি রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার যাতে না হয় আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। কিন্তু এই পরিকল্পিত বিচার যদি সত্যি সত্যি শুরু হয়, তার ফলে যে তিক্ততার সৃষ্টি হকে তাতে ভারত ও ‘বাংলাদেশের’ সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়বে।’ (দ্য আমেরিকান পেপারস, পৃষ্ঠা-৮৪২)।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের পরপরই পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ওপর হামলা ও হয়রানি শুরু হয়ে যায়। বাড়ি লুট, ছুড়িকাঘাত ও অন্যান্য ঘটনা মার্চের গোড়ার দিকে এতোটা বেড়ে যায় যে শেখ মুজিব জাতিসংঘের মহাসচিব ওয়াল্ডহাইমের কাছে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ জানিয়ে আবেদন পত্র লিখতে বাধ্য হন।
সে সময় আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টায় অনেক আটকে পড়া বাঙালি বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। কেউ ডাকাতের হাতে পড়ে সবকিছু খোয়াচ্ছিলেন, কেউ কেউ মারাও গেলেন। যাতে বাঙালিরা দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য এ সময় পাকিস্তান প্রতিটি পলায়নরত বাঙালিকে ধরিয়ে দিতে পারলে এক হার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭২)।
শুরুতে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী থাকলেও বাংলাদেশ প্রথমে বিচারের জন্য ১৫০০ অফিসার ও সৈন্যকে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তা ছাঁটাই করে ১৯৫-এ নামিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত প্রচার করার কিছু পরেই ভুট্টো ২০৩ জন বাঙালিকে ‘গুপ্তচর’ উল্লেখ করে জানান যে, তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে না, বরং নিজ দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করবেন।
‘আমরা পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচারের কোনো চেষ্টাকে মেনে নেব না। সে চেষ্টা হলে পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমাদের সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের বিচার হলে আমাদের এখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তার বিরুদ্ধে শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতার বিক্ষোভ হবে, সেনাবাহিনীতেও প্রতিক্রিয়া হবে। আমাদের নাকে এভাবে খত দেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা তা মেনে নেবো না। জনমত এখানেও বিচারের দাবি করবে। আরও জানি, বাঙালিরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে।’ (নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো। ২৮ মে ১৯৭৩।)
এ গেলো একটি দিক। আরেকটি দিক হচ্ছে পাকিস্তানের স্বীকৃতি পাওয়া। নানা কারণে সে সময় সরকার এই স্বীকৃতি অর্জনকে অত্যন্ত বড় করে দেখছিলেন। এ নিয়ে অনেক বিস্তারিত জানা যায় হাসান ফেরদৌসের ‘১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া’ বইটিতে।
তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী ছিল একাধিক কারণে। নব্য স্বাধীন দেশটি কাগজে কলমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও টিকে থাকার এক মরণপন সংগ্রাম তার মাত্র শুরু হয়েছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে তার অবকাঠামো বিধ্বস্ত, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে রয়েছে, শোনা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষের অশনিসংকেত। সে সময়ে তার একমাত্র বন্ধু বলতে প্রতিবেশী ভারত ও তারই সূত্রে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশকে সাহায্য করার ক্ষমতা কারোই অফুরন্ত নয়। তেলসম্মৃদ্ধ আরব দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়ালে অবস্থা খানিকটা বদলায়। কিন্তু পাকিস্তানকে নারাজ করে তাদের কেউ সে পথে পা বাড়াবে না।’
কতগুলো ঘটনার কথা এসময় মনে রাখতে হবে।
১. জাতিসংঘের সদস্যপদ বাংলাদেশ পাচ্ছিলো না চীনের ভেটোর কারণে।
২. ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
৩. আরব দেশগুলো ছিল বৈরি। বাংলাদেশ যাতে স্বীকৃতি না পায় এজন্য ভুট্টো আরবদেশগুলোতে ব্যাপক সফরও করেছিলেন।
৪. বিশ্বব্যাংক এসময় সাহায্য দেওয়া নিয়ে নানা সমস্যা তৈরি করছিল। (এ নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বইটিতে।)
৫. ভুট্টো এমন অবস্থা তৈরি করেছিলেন যাতে চীন ও আরব দেশগুলো তাকে ছাড়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়।
৬. যুক্তরাষ্ট্রও তখনও বাংলাদেশের প্রতি নমনীয় না।
৭. আবার ৭৪ এর দিকে এসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আগের মতো ভাল ছিল না।
৮. যুদ্ধবন্দীদের বিচার করলে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেবে না এটা পাকিস্তান স্পষ্টই জানিয়ে দেয়। আর বাংলাদেশ বলতে শুরু করে স্বীকৃতি না দিলে এ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো বৈঠক হতে পারে না। অর্থাৎ যুদ্ধবন্দী ও স্বীকৃতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরে।
এর পরের ঘটনা এরকম। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ইসলামি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন যে যুদ্ধাপরাধের জন্য যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে তিনি প্রস্তুত। এরপরই ৯ এপ্রিল ভারতে তিনপরে একটি চুক্তি হয়, যাকে বলা হয় দিল্লী চুক্তি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যপারে সব দাবি তুলে নেয়।
হাসান ফেরদৌস যেমনটি লিখেছেন, ‘যেভাবেই হোক, পাকিস্তানের সঙ্গে একধরণের সমঝোতায় আসার জন্য যে ক্রমবর্ধিত চাপ, তা সহ্য করার ক্ষমতা সে মুহূর্তে বাংলাদেশের ছিল না।’
ফলে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। তারপরেও ভবিতব্য ঠেকাতে পারেননি তিনি। এই ৭৪ সালেই বড় ধরণের দুর্ভিক্ষ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা টালবাহানা করে কথা না শোনার প্রতিশোধ নিয়েছে। আরব দেশগুলোও এগিয়ে আসেনি। আর ৭৫-এ তো জীবনই দিতে হল।
বঙ্গবন্ধুর আরও একটি বড় দোষ ছিল। দিল্লীর ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর লন্ডনের গার্ডিয়ার পত্রিকা এ নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লিখেছিল। পত্রিকাটি লেখে, ‘মুজিব ঠকেছেন, কারণ দেশের ভেতরে নেতা হিসেবে তাঁর দক্ষতা সত্বেও তিনি আসলে একজন নেহায়তই ভালো ও সৎ মানুষ। ভুট্টো প্রতিটি পদেক্ষেপে মুজিবের কোমল প্রকৃতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারে সক্ষম হন।’
‘একাত্তরের সংকটের জন্য কিছু লোক সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে, আবার কেউ কেউ দায়ী করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে যে আমরা সঠিক ছিলাম। গোলাম আজম সাহেবসহ সাধারণ মানুষ এখনো মনে করেন না আমরা ভুল করেছি।’
১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদে জেনারেল টিক্কা খানের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মুসা সাদিক। মুসা সাদিক মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধ সংবাদদাতা ছিলেন। আর এই সাক্ষাৎকারটি পেলাম তাঁর বই ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’-এ।
এটুকু পড়তে পড়তেই মনে পড়ে গেল যতীন সরকারের ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বইটির কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রুকন উদ্দিন মুন্সী নামের এক ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গের কথোপকথন তিনি তুলে দিয়েছিলেন।
‘……কুকুর মানুষের এতো উপকার করে, তবু কুকুরের ছোঁয়া লাগলে অজু নষ্ট হয়ে যায় কেন বলতে পারেন?’
‘তা আমি কি করে বলবো? এর জবাব তো আপনিই ভাল জানেন’।
‘তা হলে শুনুন। কুকুর মানুষের উপকার করে ঠিকই, কিন্তু তার স্বজাতিকে সে দু’চোখে দেখতে পারে না। পরজাতি মানুষের জন্য কুকুর জান দেয়, কিন্তু স্বজাতির কাউকে দেখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কামড়াকামড়ি করে। কুকুর তার স্বজাতিকে অর্থাৎ অন্য কুকুরকে ভালবাসে-এরকম আপনি কোখাও দেখতে পাবেন না। স্বজাতিকে এমন হিংসা করে বলেই কুকুর প্রাণীটা একেবারে না-পাক।’
একটু থেমে আবার সেই মহাকুমা শহরের শান্তি কমিটির চাঁইদের কথা তুললেন রুকন উদ্দিন মুন্সী। বললেন,‘ওরাও ওই কুকুরের মতো। ওরা পরজাতি পাকিস্তানিদের জন্যে জান কোরবান করতে নেমেছে স্বজাতি বাঙালিদের সর্বনাশ করে। ওরাও না-পাক। যতো বড়ো আলেমই হোক এরা, এদের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লে তা কবুল হবে না কিছুতেই।’
এই কুকুরগুলোর কর্মকান্ড কমবেশি সকলেরই জানা। এ নিয়ে অসংখ্য লেখা আছে। পাকিস্তানিরাও কিন্তু অল্প হলেও কিছু লিখেছেন। এরকম একটি বই হচ্ছে সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার।’ সিদ্দিক সালিক ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে টিক্কা খান ও পরে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি লিখেছেন, ‘…..‘দেশপ্রেমিক’ পাকিস্তানিদের খবরের ওপর ভিত্তি করে তারা প্রায়শই ‘সন্ধান উচ্ছেদকরণ অপারেশন’ চালাতে লাগলো। খবর সরবরাহকারীদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানের সংহতির ব্যাপারে সত্যিকার অর্থেই আগ্রহী ছিল এবং সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য জীবনের ঝুঁকিও নিত। কিছু অবশ্য আওয়ামী লীগপন্থীদের নিজেদের পুরানো ক্ষত মীমাংশার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে নিজেদের যোগাযোগকে ব্যবহার করতো। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একদিন একজন দক্ষিনপন্থী রাজনীতিক একটি তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক আইন সদর দফতরে আসে। বারান্দাতে হঠাৎ করেই তার সাথে আমার দেখা। আস্থাভরে ফিসফিসিয়ে সে বললো, ‘বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর তার কাছে আছে।’ আমি তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে সে বললো, ‘বালকটি তার ভাইয়ের ছেলে। সে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পার কেরানীগঞ্জের বিদ্রোহীদের বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে।’ বালকটি আরো বললো, ‘বিদ্রোহীরা শুধু স্থানীয় লোকজনদের হয়রানিই করছে না-রাতে শহর আক্রমনের পরিকল্পনা নিয়েছে।’
তৎক্ষনাৎ উচ্ছেদকরণ অপারেশনের আদেশ দেওয়া হয়। আক্রমণকারী সৈন্যদের কমান্ডারকে ব্রিফ করা হলো। ভোর হবার আগেই ল্যকে নমনীয় করার উদ্দেশ্যে গোলাবর্ষনের জন্য ফিল্ডগান, মর্টার ও রিকয়েললেস রাইফেলস প্রস্তুত করা হলো। স্থানটি সকাল হবার আগেই দখল করবার জন্যে সৈন্যরা সাঁড়াশি অভিযান চালাবে।
যে অফিসার হামলা পরিচালনা করে, সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করলাম। সে যা বললো, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘ওখানে কোনো বিদ্রোহী ছিল না। ছিল না অস্ত্রও। শুধু গ্রামের গরিব লোকেরা-অধিকাংশ নারী এবং বৃদ্ধ। গোলার আগুনের মাঝে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, গোয়েন্দা মারফত সঠিক সংবাদ সংগ্রহ না করেই এই হামলা পরিচালিত হয়েছে। আমার বিবেকের ওপর এ ভার আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াবো।’
তারপরেও দেশ স্বাধীন হল। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরলেন দেশে। দেশ চালানোর ভার নিলেন। ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭২।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারি প্রেসনোটের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা জানানো হয়। একইসঙ্গে দালাল আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। (১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বরের আগে পর্যন্ত দালাল আইনের মামলাগুলোয় ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে এদের ২৬ হাজার ছাড়া পেয়ে যায়। আর ১১ হাজার দালাল বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ভোগ করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএসএম সায়েম ও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার পুরোপুরি দালাল আইন বাতিল করার পর ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই আপিল করে এরা সব ছাড়া পেয়ে যায়। ছাড়া পাওয়া দালালদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার আসামিরাও ছিল।)
প্রশ্ন হচ্ছে কেন বঙ্গবন্ধু এতখানি নমনীয় হয়েছিলেন দালালদের প্রতি। কেনই বা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীদের বিচার করতে পারলেন না।
‘ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গেলাম গণভবণে। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খান আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর অফিস কক্ষে। কয়েকজন মন্ত্রী তখন সেখানে উপস্থিত। তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিলেন। বললেন, এখনি একটা সরকারি ঘোষণার খসড়া তোমাকে লিখতে হবে। পাকিস্তানীদের মধ্যে কোলাবরেটর হিসেবে যারা দন্ডিত ও অভিযুক্ত হয়েছেন, সকলের জন্যও ঢালাও ক্ষমা (জেনারেল এ্যামনেষ্টি) ঘোষণা করতে যাচ্ছি।
বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, পালের গোদাদেরও ছেড়ে দেবেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। সকলকে। কেবল যাদের বিরুদ্ধে খুন, রাহাজানি, ঘরে আগুন দেয়া, নারী-হরণ বা ধর্ষণ প্রভৃতির অভিযোগ রয়েছে, তারা ছাড়া পাবেন না। কেন, ঢালাও ক্ষমা ঘোষণায় তোমার মত নেই?
বললাম, না, নেই। পাকিস্তানীদের অত্যাচারে সাহায্য যোগানের অভিযোগে যে হাজার হাজার লোক বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের প্রতি আপনি ক্ষমা প্রদর্শন করুন। আপত্তি নেই। তাদের অনেকেই নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য জোগাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পালের গোদাদের আপনি ক্ষমা করবেন না। এরা বাংলাদেশের শত্রু। এদের বিচার ও দন্ড হওয়া দরকার।
মুজিব হেসে বললেন, না তা হয় না। সকলকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমার এ আসনে বসলে তোমাকেও তাই করতে হত। আমিতো চেয়েছিলাম নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে অন্তত ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধী অফিসারের বিচার করতে। তাও পেরেছি কী? আমি একটা ছোট্ট অনুন্নত দেশের নেতা। চারিদিকে উন্নত ও বড় শক্তির চাপ। ইচ্ছা থাকলেই কি আর সব কাজ করা যায়?’ (ইতিহাসের রক্তপলাশ: পনের আগস্ট পঁচাত্তর, আবদুল গাফফার চৌধুরী।)
আসলে কি হচ্ছিল তখন?
১৫ এপ্রিল, ১৯৭২। মার্কিণ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি গোপন চিঠি লেখেন ভুট্টো। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘ভারতীয় মদদে শেখ মুজিবুর রহমান এক হাজার ৫০০ যুদ্ধবন্দীর ‘যুদ্ধাপরাধের’ জন্য বিচারের ব্যাপারে বন্ধপরিকর বলে মনে হয়। যদি বাংলাদেশ সত্যি সত্যি তেমন পথে এগোয়, তাহলে তার মারাত্বক প্রতিক্রিয়া হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানে লাখ খানেক বাঙালি রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার যাতে না হয় আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। কিন্তু এই পরিকল্পিত বিচার যদি সত্যি সত্যি শুরু হয়, তার ফলে যে তিক্ততার সৃষ্টি হকে তাতে ভারত ও ‘বাংলাদেশের’ সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়বে।’ (দ্য আমেরিকান পেপারস, পৃষ্ঠা-৮৪২)।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের পরপরই পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ওপর হামলা ও হয়রানি শুরু হয়ে যায়। বাড়ি লুট, ছুড়িকাঘাত ও অন্যান্য ঘটনা মার্চের গোড়ার দিকে এতোটা বেড়ে যায় যে শেখ মুজিব জাতিসংঘের মহাসচিব ওয়াল্ডহাইমের কাছে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ জানিয়ে আবেদন পত্র লিখতে বাধ্য হন।
সে সময় আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টায় অনেক আটকে পড়া বাঙালি বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। কেউ ডাকাতের হাতে পড়ে সবকিছু খোয়াচ্ছিলেন, কেউ কেউ মারাও গেলেন। যাতে বাঙালিরা দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য এ সময় পাকিস্তান প্রতিটি পলায়নরত বাঙালিকে ধরিয়ে দিতে পারলে এক হার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭২)।
শুরুতে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী থাকলেও বাংলাদেশ প্রথমে বিচারের জন্য ১৫০০ অফিসার ও সৈন্যকে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তা ছাঁটাই করে ১৯৫-এ নামিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত প্রচার করার কিছু পরেই ভুট্টো ২০৩ জন বাঙালিকে ‘গুপ্তচর’ উল্লেখ করে জানান যে, তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে না, বরং নিজ দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করবেন।
‘আমরা পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচারের কোনো চেষ্টাকে মেনে নেব না। সে চেষ্টা হলে পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমাদের সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের বিচার হলে আমাদের এখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তার বিরুদ্ধে শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতার বিক্ষোভ হবে, সেনাবাহিনীতেও প্রতিক্রিয়া হবে। আমাদের নাকে এভাবে খত দেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা তা মেনে নেবো না। জনমত এখানেও বিচারের দাবি করবে। আরও জানি, বাঙালিরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে।’ (নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো। ২৮ মে ১৯৭৩।)
এ গেলো একটি দিক। আরেকটি দিক হচ্ছে পাকিস্তানের স্বীকৃতি পাওয়া। নানা কারণে সে সময় সরকার এই স্বীকৃতি অর্জনকে অত্যন্ত বড় করে দেখছিলেন। এ নিয়ে অনেক বিস্তারিত জানা যায় হাসান ফেরদৌসের ‘১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া’ বইটিতে।
তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী ছিল একাধিক কারণে। নব্য স্বাধীন দেশটি কাগজে কলমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও টিকে থাকার এক মরণপন সংগ্রাম তার মাত্র শুরু হয়েছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে তার অবকাঠামো বিধ্বস্ত, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে রয়েছে, শোনা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষের অশনিসংকেত। সে সময়ে তার একমাত্র বন্ধু বলতে প্রতিবেশী ভারত ও তারই সূত্রে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশকে সাহায্য করার ক্ষমতা কারোই অফুরন্ত নয়। তেলসম্মৃদ্ধ আরব দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়ালে অবস্থা খানিকটা বদলায়। কিন্তু পাকিস্তানকে নারাজ করে তাদের কেউ সে পথে পা বাড়াবে না।’
কতগুলো ঘটনার কথা এসময় মনে রাখতে হবে।
১. জাতিসংঘের সদস্যপদ বাংলাদেশ পাচ্ছিলো না চীনের ভেটোর কারণে।
২. ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
৩. আরব দেশগুলো ছিল বৈরি। বাংলাদেশ যাতে স্বীকৃতি না পায় এজন্য ভুট্টো আরবদেশগুলোতে ব্যাপক সফরও করেছিলেন।
৪. বিশ্বব্যাংক এসময় সাহায্য দেওয়া নিয়ে নানা সমস্যা তৈরি করছিল। (এ নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বইটিতে।)
৫. ভুট্টো এমন অবস্থা তৈরি করেছিলেন যাতে চীন ও আরব দেশগুলো তাকে ছাড়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়।
৬. যুক্তরাষ্ট্রও তখনও বাংলাদেশের প্রতি নমনীয় না।
৭. আবার ৭৪ এর দিকে এসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আগের মতো ভাল ছিল না।
৮. যুদ্ধবন্দীদের বিচার করলে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেবে না এটা পাকিস্তান স্পষ্টই জানিয়ে দেয়। আর বাংলাদেশ বলতে শুরু করে স্বীকৃতি না দিলে এ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো বৈঠক হতে পারে না। অর্থাৎ যুদ্ধবন্দী ও স্বীকৃতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরে।
এর পরের ঘটনা এরকম। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ইসলামি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন যে যুদ্ধাপরাধের জন্য যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে তিনি প্রস্তুত। এরপরই ৯ এপ্রিল ভারতে তিনপরে একটি চুক্তি হয়, যাকে বলা হয় দিল্লী চুক্তি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যপারে সব দাবি তুলে নেয়।
হাসান ফেরদৌস যেমনটি লিখেছেন, ‘যেভাবেই হোক, পাকিস্তানের সঙ্গে একধরণের সমঝোতায় আসার জন্য যে ক্রমবর্ধিত চাপ, তা সহ্য করার ক্ষমতা সে মুহূর্তে বাংলাদেশের ছিল না।’
ফলে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। তারপরেও ভবিতব্য ঠেকাতে পারেননি তিনি। এই ৭৪ সালেই বড় ধরণের দুর্ভিক্ষ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা টালবাহানা করে কথা না শোনার প্রতিশোধ নিয়েছে। আরব দেশগুলোও এগিয়ে আসেনি। আর ৭৫-এ তো জীবনই দিতে হল।
বঙ্গবন্ধুর আরও একটি বড় দোষ ছিল। দিল্লীর ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর লন্ডনের গার্ডিয়ার পত্রিকা এ নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লিখেছিল। পত্রিকাটি লেখে, ‘মুজিব ঠকেছেন, কারণ দেশের ভেতরে নেতা হিসেবে তাঁর দক্ষতা সত্বেও তিনি আসলে একজন নেহায়তই ভালো ও সৎ মানুষ। ভুট্টো প্রতিটি পদেক্ষেপে মুজিবের কোমল প্রকৃতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারে সক্ষম হন।’
শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০১০
দুষ্মন্তপুরান
Written by AZHAR
রাজা চৌকীতে হেলান দিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। তাহার সম্মুখেই রাজপরিচারিকা উবু হইয়া ঘর ঝাড়ু দিতেছিল। বেটি বড়ই বেশরম,অর্ন্তবাস বলিয়া যে একটা জিনিষ আছে বোধহয় জানেই না। রাজা নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করিতেছিলেন। এমন সময় দুম করে দরজা খুলিয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রবেশ।
রাজা যারপরনাই বিরক্ত হইয়া কহিলেন, মন্ত্রী,বলি বোধবুদ্ধি সব সরবতের সহিত গুলিয়া খাইয়া ফেলিয়াছ নাকি? তোমাকে না বলিয়াছি, দেখা করিবার পূর্বে একটা মিস কল দিবে,নিদেন পক্ষে একটা টেক্সট।
মন্ত্রী চারিদিক চোখ বুলিয়া পরিবেশ সম্পর্কে ধারনা করিলেন,অতঃপর রাজাকে কহিলেন, রাজামশাই,এই রোজা রমজানের মাসে ভর দুপুরে এসব চোখের জেনা না করিয়া বরং দু’রাকাত নামায পড়িলেও তো পারেন।
রাজার মেজাজ সপ্তমে চড়িল। কহিলেন, মন্ত্রী,তোমাকে বেতন দিয়া রাখিয়াছি কি আমাকে ধর্ম দীক্ষা দিবার নিমিত্ত? যা বলিতে আসিয়াছিলা বলিয়া ফেল।
মন্ত্রী কহিল, দুর্নীতি,ঘোর দুর্নীতি। রাজকোষাগারের টাকায় মহেঞ্জোদারো রাজ্য হইতে পাঁচখানা ঘোড়া কিনা হইয়াছিল। ঘোড়াগুলা বড়ই মনোহর। লম্বা চওড়া,তাগড়া। একটানা দু’দিন দু’রাত ছুটতে পারে। কেশর জানি পারস্যের মখমলকেও হার মানায়।
রাজা কহিলেন, বুঝিয়াছি। আগে বল।
মন্ত্রী বলিতে লাগিলেন, ঘোড়াগুলান বন্দরে খালাস করিতে গিয়াছিলাম, ওম্নি সেনাপতি আসিয়া একখানা ঘোড়া লইয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই মানা করতে গেলুম, ওম্নি তরবারীখানা দেখাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা গম্ভীরভাবে কহিলেন, হুম।
মন্ত্রী বলিয়া চলিলেন, বাকি চারটা লইয়া ফিরিতেছিলাম, হঠাৎ রাস্তায় সমরমন্ত্রী আসিয়া বহর থামাইলেন, আর একটা ঘোড়ায় চড়িয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই থামাতে গেলুম, ওম্নি খঞ্জর বাহির কইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা দাঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কহিলেন, প্রাসাদের ফটকে রাজখাজাঞ্চী আমাদের পথরোধ করিলেন,একটা ঘোড়া বাছিয়া লইলেন,উহায় চড়িয়া প্রস্থান করিলেন। আমি কহিলাম,ওটা তো রাজদরবারের সম্পত্তি। তিনি একটা বল্লম বাগাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা চৌকি হইতে উঠিয়া কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী বলিলেন,ঘোড়াগুলি আস্তাবলে ঢুকাইতে যাইব, এমন সময় রাজ দরবারের ভাঁড় আসিয়া আরেকটা ঘোড়ায় লাগাম পরাইতে লাগিল। যেই আমি বাধা দিলাম,ওম্নি একটা ছুরি বাগাইয়া ধরিয়া কহিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা একখানা কদলি ছিলিতে ছিলিতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কাতরাইয়া উঠিলেন, রাজামশাই,জলদি কিছু করুন। এরকম দিনে দূপুরে ছিনতাইয়ের সমুচিত শাস্তি দিন। এরা বড্ড বাড় বাড়িয়াছে। আজ ঘোড়া চুরি করিয়াছে, কাল রাজকোষ থেকে সোনাদানা চুরি করিবে। রাজ্যের মানসম্মান এরা ডুবাইবে। প্রজারা শুনলে ছিছি করিবে। আশেপাশের রাজ্যে মুখ দেখাবার জো থাকিবে না।
রাজা কহিলেন, ঘোড়াগুলির দাম কত পড়েছে?
মন্ত্রী কহিলেন, তা প্রায় আড়াই কোটি স্বর্নমুদ্রা।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, রাজকোষের টাকা কোত্থেকে আসে?
মন্ত্রী বলিলেন, কেন, করের টাকা থেকে।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, কর কারা দেয়?
মন্ত্রী কহিলেন, কেন, প্রজারা?
রাজা কহিলেন, তাহলে এইবার বল, তুমি আমি কি প্রজা?
মন্ত্রী একটু চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, কহিলেন, ডেফিনিশন অনুযায়ী তো আমরা ঠিক প্রজা না।
রাজা কহিলেন, তাহা হইলে তোমার এতো মাথা ব্যথা কেন হে?
মন্ত্রী মাথা চুল্কাইয়া কহিল, কিন্তু ডেমোক্রেসি বলিয়াও তো একটা ব্যাপার আছে।
রাজা বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে ডেমোক্রেসির মায়েরে বাপ। ডেমোক্রেসি গুলাইয়া কি ইসবগুলের ভুষি বানাইয়া খাইবা? দিনরাত জনগনের জন্য বেগার খাটিতেছি, জনগনের কি কোনো রেস্পন্সিবিলিটি নাই আমাদিগের প্রতি? না হয় দু’তিনটা ঘোড়াই রাজন্যবর্গ লইয়াছে,তাহার জন্য কি চেঁচিয়ে রাজ্যের সকলের কান ভারী করিতে হইবে? আমার বুদ্ধি শুনো, বাকি ঘোড়াটি তুমি মারিয়া দাও। তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের ঘোড়া চড়িবার অনেক শখ, তাহার মনষ্কামনা পূর্ণ কর। আর যদি বেশি চিল্লাবাল্লা কর, তাইলে পশ্চাদ্দেশে লাত্থি মারিয়া রাজসভা হইতে ভাগাইয়া দেব।
মন্ত্রী বাকরুদ্ধ হইয়া রাজার কথা শুনিতেছিলেন, রাজার কথা শেষ হইলে আপন মনেই বিড়বিড় করিলেন, পাপ হইতেছে, ঘোর পাপ।
মন্ত্রীর কথা রাজার কানে পৌছুল। তিনি রেগে বোম হইয়া এক লম্ফে মন্ত্রীর সামনে দন্ডায়মান হইলেন, তারপর হাতের কদলি মন্ত্রীর দিকে বাগাইয়া বলিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা চৌকীতে হেলান দিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। তাহার সম্মুখেই রাজপরিচারিকা উবু হইয়া ঘর ঝাড়ু দিতেছিল। বেটি বড়ই বেশরম,অর্ন্তবাস বলিয়া যে একটা জিনিষ আছে বোধহয় জানেই না। রাজা নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করিতেছিলেন। এমন সময় দুম করে দরজা খুলিয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রবেশ।
রাজা যারপরনাই বিরক্ত হইয়া কহিলেন, মন্ত্রী,বলি বোধবুদ্ধি সব সরবতের সহিত গুলিয়া খাইয়া ফেলিয়াছ নাকি? তোমাকে না বলিয়াছি, দেখা করিবার পূর্বে একটা মিস কল দিবে,নিদেন পক্ষে একটা টেক্সট।
মন্ত্রী চারিদিক চোখ বুলিয়া পরিবেশ সম্পর্কে ধারনা করিলেন,অতঃপর রাজাকে কহিলেন, রাজামশাই,এই রোজা রমজানের মাসে ভর দুপুরে এসব চোখের জেনা না করিয়া বরং দু’রাকাত নামায পড়িলেও তো পারেন।
রাজার মেজাজ সপ্তমে চড়িল। কহিলেন, মন্ত্রী,তোমাকে বেতন দিয়া রাখিয়াছি কি আমাকে ধর্ম দীক্ষা দিবার নিমিত্ত? যা বলিতে আসিয়াছিলা বলিয়া ফেল।
মন্ত্রী কহিল, দুর্নীতি,ঘোর দুর্নীতি। রাজকোষাগারের টাকায় মহেঞ্জোদারো রাজ্য হইতে পাঁচখানা ঘোড়া কিনা হইয়াছিল। ঘোড়াগুলা বড়ই মনোহর। লম্বা চওড়া,তাগড়া। একটানা দু’দিন দু’রাত ছুটতে পারে। কেশর জানি পারস্যের মখমলকেও হার মানায়।
রাজা কহিলেন, বুঝিয়াছি। আগে বল।
মন্ত্রী বলিতে লাগিলেন, ঘোড়াগুলান বন্দরে খালাস করিতে গিয়াছিলাম, ওম্নি সেনাপতি আসিয়া একখানা ঘোড়া লইয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই মানা করতে গেলুম, ওম্নি তরবারীখানা দেখাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা গম্ভীরভাবে কহিলেন, হুম।
মন্ত্রী বলিয়া চলিলেন, বাকি চারটা লইয়া ফিরিতেছিলাম, হঠাৎ রাস্তায় সমরমন্ত্রী আসিয়া বহর থামাইলেন, আর একটা ঘোড়ায় চড়িয়া হাঁটা দিলেন। আমি যেই থামাতে গেলুম, ওম্নি খঞ্জর বাহির কইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা দাঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কহিলেন, প্রাসাদের ফটকে রাজখাজাঞ্চী আমাদের পথরোধ করিলেন,একটা ঘোড়া বাছিয়া লইলেন,উহায় চড়িয়া প্রস্থান করিলেন। আমি কহিলাম,ওটা তো রাজদরবারের সম্পত্তি। তিনি একটা বল্লম বাগাইয়া কহিলেন, বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা চৌকি হইতে উঠিয়া কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী বলিলেন,ঘোড়াগুলি আস্তাবলে ঢুকাইতে যাইব, এমন সময় রাজ দরবারের ভাঁড় আসিয়া আরেকটা ঘোড়ায় লাগাম পরাইতে লাগিল। যেই আমি বাধা দিলাম,ওম্নি একটা ছুরি বাগাইয়া ধরিয়া কহিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
রাজা একখানা কদলি ছিলিতে ছিলিতে কহিলেন,হুম।
মন্ত্রী কাতরাইয়া উঠিলেন, রাজামশাই,জলদি কিছু করুন। এরকম দিনে দূপুরে ছিনতাইয়ের সমুচিত শাস্তি দিন। এরা বড্ড বাড় বাড়িয়াছে। আজ ঘোড়া চুরি করিয়াছে, কাল রাজকোষ থেকে সোনাদানা চুরি করিবে। রাজ্যের মানসম্মান এরা ডুবাইবে। প্রজারা শুনলে ছিছি করিবে। আশেপাশের রাজ্যে মুখ দেখাবার জো থাকিবে না।
রাজা কহিলেন, ঘোড়াগুলির দাম কত পড়েছে?
মন্ত্রী কহিলেন, তা প্রায় আড়াই কোটি স্বর্নমুদ্রা।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, রাজকোষের টাকা কোত্থেকে আসে?
মন্ত্রী বলিলেন, কেন, করের টাকা থেকে।
রাজা কহিলেন, বলত মন্ত্রী, কর কারা দেয়?
মন্ত্রী কহিলেন, কেন, প্রজারা?
রাজা কহিলেন, তাহলে এইবার বল, তুমি আমি কি প্রজা?
মন্ত্রী একটু চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, কহিলেন, ডেফিনিশন অনুযায়ী তো আমরা ঠিক প্রজা না।
রাজা কহিলেন, তাহা হইলে তোমার এতো মাথা ব্যথা কেন হে?
মন্ত্রী মাথা চুল্কাইয়া কহিল, কিন্তু ডেমোক্রেসি বলিয়াও তো একটা ব্যাপার আছে।
রাজা বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে ডেমোক্রেসির মায়েরে বাপ। ডেমোক্রেসি গুলাইয়া কি ইসবগুলের ভুষি বানাইয়া খাইবা? দিনরাত জনগনের জন্য বেগার খাটিতেছি, জনগনের কি কোনো রেস্পন্সিবিলিটি নাই আমাদিগের প্রতি? না হয় দু’তিনটা ঘোড়াই রাজন্যবর্গ লইয়াছে,তাহার জন্য কি চেঁচিয়ে রাজ্যের সকলের কান ভারী করিতে হইবে? আমার বুদ্ধি শুনো, বাকি ঘোড়াটি তুমি মারিয়া দাও। তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের ঘোড়া চড়িবার অনেক শখ, তাহার মনষ্কামনা পূর্ণ কর। আর যদি বেশি চিল্লাবাল্লা কর, তাইলে পশ্চাদ্দেশে লাত্থি মারিয়া রাজসভা হইতে ভাগাইয়া দেব।
মন্ত্রী বাকরুদ্ধ হইয়া রাজার কথা শুনিতেছিলেন, রাজার কথা শেষ হইলে আপন মনেই বিড়বিড় করিলেন, পাপ হইতেছে, ঘোর পাপ।
মন্ত্রীর কথা রাজার কানে পৌছুল। তিনি রেগে বোম হইয়া এক লম্ফে মন্ত্রীর সামনে দন্ডায়মান হইলেন, তারপর হাতের কদলি মন্ত্রীর দিকে বাগাইয়া বলিলেন,বেশি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তো এইটে দিয়ে ভুঁড়ি গেলিয়ে দিব।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)